HAPPY READING...


Monday, 22 October 2018

আমার শহর ও তার বনেদিয়ানা


দুর্গাপুজোর জন্যেই সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি, ৩৬৫দিনের মধ্যে ওই ক’টা দিনই তো বাড়ি ফেরার তাড়া থাকেনা, মুক্ত পাখির মত ঘুরে ঘুরে বেড়ানো যায়! যদিও শহরে এই সময় হঠাত করেই লোকজনের ভিড় বড্ড বেশি হয়ে যায়, তাও এইপুজোই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ উৎসব যার জন্য বছরের সবক’টা দিন অপেক্ষা করে থাকি। শহরে ভিড় হলেও আমার ভিড় ভাল লাগেনা, ভাল লাগে আলো…রাস্তার দুধার বরাবর শহর ও শহরতলি নানারঙের আলোয় সেজে ওঠে, আমার তাই ভীষণ ভাল লাগে! আমি সারারাত একদল আলোর সামনে একা দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিতে পারি, আমার দুঃখ হবেনা একটুও। পুজোর এক সপ্তাহ আগে অবধি ভীষণ শরীর খারাপ ছিল, জানতাম না পুজোর আগে হেঁটে বেড়ানোর মত শক্তি পাবো কিনা, কোনো প্ল্যান হয়নি কারণ কাছের মানুষেরা এখন প্রায় সবাই দূরে। পঞ্চমীর রাত অবধি বাড়ি বসে লেখার কাজ করেছি মনেই ছিলনা আগামীকালই পুজো! বাড়ির সামনে আলো জ্বলছিল আলো জ্বলছিল সারা শহরে কেবল খামে বন্ধ করে রাখা অভিমান আমার ঘরে আলো জ্বালাতে দেয়নি। তখনো ঘরে বৃষ্টি, আর পাড়ায় উৎসবের গান বাজছে। বাকি সবার কাছে দুর্গাপুজো কি জানিনা, আমার কাছে দুর্গাপুজো এক উৎসব যাকে ঘিরে অনেক মানুষ স্বপ্ন দেখে দুবেলা ভরপেট খাবার পাওয়ার, একটা নতুন জামা গায়ে চড়ানোর কিংবা যে মা সারা বছর বাড়ি থেকে বেরোতে পারেনা সে জানে পুজোয় আমি দেবীর কাছে যাবই! এক উৎসব যাকে ঘিরে গোটা একটা শহর স্বপ্ন দেখে রাত জেগে জেগে এবং ভোর হলে একমুঠো শিউলিফুল হাতে নিয়ে একটা গোটা দিন আনন্দে কাটানোর কথা ভাবে। দুর্গাপুজোয় কাশফুল আমার খুব কাছের নয়, কাশফুল আমার নস্টালজিয়া হতে পারেনা কারণ আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে মাঠ ভর্তি কাশফুল নেই; আছে ছাদে বিছিয়ে থাকা শিউলিফুল আর অটো করে যেতে যেতে ছাতিমফুলের গন্ধ, এবারেও মহালয়ার পর পর আমি ছাতিমফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম তখন ফোনকলে ছিল অনেকদূরত্বে থাকা এক কাছের জন, তাঁকে বলেছিলাম, “আমি পুজোর গন্ধ পাচ্ছি!” 


এই পুজোর গন্ধ কখন আমাদের মন ছুঁইয়ে চলে যায় জানিনা, যার স্পর্শে সব অভিমান, রাগ ভুলে ক’টাদিন বাঁচার কথা ভাবা যায় , ঘরে ফেরার গান গাওয়া যায়! পুজোর স্পর্শ মনে নিয়ে, ঘরে ফিরে আসে দূরে থাকা বিচ্ছিন্ন পরিবার। উত্তর কলকাতার বনেদিবাড়িগুলি কয়েকদিনের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে, হাসিঠাট্টায় একসাথে মেতে ওঠে বিচ্ছিন্ন পরিবার। দূরত্ব ভালো লাগেনা, তাই তাঁদের এই দূরত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার সন্ধিক্ষণের সাক্ষী থাকার ইচ্ছে ছিল ভীষণ। ইচ্ছে ছিল, ইতিহাসকে আর একবার চোখে দেখি…সময়ের পৃষ্ঠা উলটে ফিরে যাই অনেক পুরোনো সময়ে যেখানে থিমপুজোর আড়ম্বর নেই, দড়ি ফেলে ঠাকুর দেখার তোড়জোড়ও নেই সেরম। ভিড়ে অসুস্থ হয়ে যাওয়া শিশুর কান্না নেই। আছে আনন্দ, মিলন, দেবী দুর্গার সাবেকী রূপ, ঝাড়লন্ঠন ও মুঠোভর্তি শিউলিফুল! আগেই বলেছিলাম, পূর্বপরিকল্পনা ছিলনা। আমার এক বন্ধু এবং আমি ষষ্ঠীর দিন রাত্রে হঠাতই প্ল্যান করি অষ্টমীর। উত্তরের অলিগলি আমরা চিনতাম না, আমরা এক ওয়েবসাইট থেকে ম্যাপ দেখে ও দোকানকাকুদের জিজ্ঞেস করে দশটা বাড়িতে পৌঁছাই। তীব্র অভিমানের পর দীর্ঘ রাস্তা হাঁটলে যেমন অনুভূতি হয় সেদিনও তেমন অনুভূতি হয়েছিল। এতযাবত সমস্ত অষ্টমীর মধ্যে এই মুহূর্ত ছিল সেরা মুহূর্ত আমার শ্রেষ্ঠ শারদীয়া। মেট্রো বেলায় চলা শুরু হওয়ার জন্য আমাদের যাওয়ার একটু অসুবিধে হয়েছিল, নয়তো গিরীশ পার্ক মেট্রোয় নেমে এই যাত্রা শুরু হতে পারে, যে বাড়িগুলির তালিকা আমি নিচে করলাম।
প্রথমে আমরা অলিগলির ভেতর দিয়ে পৌঁছাই শিবকৃষ্ণ দাঁ-এর বাড়ি, সকাল থেকে হাজারো মন খারাপের পর বনেদিবাড়ির পুজোর ছোঁয়া আমায় এসে স্পর্শ করতেই আমার আর কোনো মন খারাপ থাকেনি, কারোর থাকতে পারেনা!

) শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ির পুজো
১২এ, শিবকৃষ্ণ দাঁ লেন, কলকাতা (গিরিশপার্কের কাছে)

বিখ্যাত ব্যবসায়ী গোকুল চন্দ্র দাঁ কলকাতায় জোড়াসাঁকোয় এসে বসবাস শুরু করেন, এবং তাঁর নিজস্ব আত্মীয়ের পুত্র শিবকৃষ্ণ দত্তকে পুত্র রূপে দত্তক নেন পরবর্তীকালে শিবকৃষ্ণ দাঁ এই বাড়ির দুর্গাপুজোর ঐতিহ্যকে বহাল রাখেন এবং তারও পরবর্তীকালে এখনো পর্যন্ত এই পুজো বংশপরম্পরায় আড়ম্বরের সহিত হয়ে আসছে শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ির ঠাকুর দালান বিভিন্ন চলচ্চিত্রে দৃশ্যায়িত হয়ে থাকে রেললাইন নির্মানে শিবকৃষ্ণ দাঁ-এর এক বড় অবদান রয়েছে

শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ি ও ঠাকুর দালান

শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা



শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ির ঠাকুর দেখার পর, আমরা এধার ওধার হারিয়ে জল খেয়ে একটু ঝগড়া করে একে অপরকে দোষ দিয়ে পৌঁছাই নরসিংহ দাঁ-এর বাড়ি পৌঁছে দেখি সেখানে ধুনোর ধোঁয়ায় পরিবেশ ভরে আছে, ঢাক বাজছে ঠাকুর দালানের সামনে...

) জোড়াসাঁকো (নরসিংহ দাঁ বাড়ি),
পাশাপাশি দুই বাড়ি ,  ২০ বিবেকানন্দ রোড,  কলকাতা
১৮৫৯ সাল  থেকে  নরসিংহ দাঁ  এই  পুজোর  প্রচলন  শুরু  করেন বন্দুক  ব্যবসায়ী  উনিশ  শতকের  প্রথমার্ধে  এন সি দাঁ নামে  খ্যাত  ছিলেন  বৈষ্ণব মতে পুজো হওয়ায় এই বাড়ির পুজোয় বলি হওয়ার নিয়মাবলী নেই বাড়ির লোকের বিশ্বাস সন্ধিপুজোর সময়ে বাড়িতে আবির্ভাব ঘটে স্বয়ং দেবীর, তাঁরা নাকি এমন অনুভব করতেও পারেন বিসর্জনের আগে দেবীকে বাড়িতেই সাত পাক ঘোরানো হয়, এবং বিদায়ের আগে দেওয়া হয় গান স্যালুট এমন ঐতিহ্য এই পরিবার দেড়শো বছরের উপর বহন করে আসছে
নরসিংহ দাঁ বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা



নরসিংহ দাঁ বাড়ির ঠাকুর দালান




এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাই বলরাম দে  স্ট্রিট দত্তবাড়িতে, সেখানে তখন পরিবারের লোকেরা একে অপরের সাথে আড্ডায় মশগুল..

৩) বলরাম দে স্ট্রিট, দত্তবাড়ির পুজো (ঘোষ পরিবারের পুজো)
১৫৯, বলরাম দে স্ট্রিট, উত্তর কলকাতা (গিরিশ পার্ক মেট্রোর কাছে)

বলরাম দে স্ট্রিট দত্তবাড়ির পুজোর প্রতিষ্ঠাতা হলেন শ্যামল ধন দত্ত, পরবর্তীকালে তার কন্যা রাজলক্ষ্মীই পুজোর দায়িত্ব নেন। তিনি ও তাঁর স্বামী শরত ঘোষ এই পুজার দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৩৬ বছর ধরে এই পুজো হয়ে আসছে।
বলরাম দে স্ট্রিট দত্তবাড়ির ঠাকুর দালান
                 


 সপ্তমী থেকে নবমী অবধি এই পুজোয় একজন সধবা ও একজন কুমারী কন্যার পুজোও হয়।  এইখানে দেবীর বাহন সিংহ নয়, ঘোড়ার পিঠে দেবী বিরাজ করেন। পুরোনো রীতি অনুযায়ী, ষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধনের সময় নারায়ণ ঠাকুরকে বাড়ির মূল ফটকের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়, দত্ত বাড়ির পুজোয় দেবী দুর্গাকে আহ্বান জানান স্বয়ং নারায়ণ।



দত্তবাড়ির দুর্গাপ্রতিমা


আমাদের দুর্গারা



দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট খুঁজে পেতে কম হাঁটতে হয়নি কিন্তু এখন সেই একসাথে হাঁটার সময়টাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে।

৪) বৈষ্ণবদাস মল্লিক পরিবারের দুর্গাপুজো
৩২ দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রীট, কলকাতা (গিরিশপার্ক মেট্রোর কাছে)
প্রবেশদ্বার পেরিয়ে উঠোনে পৌঁছাতেই আপনা হতে চোখ চলে যায় পাঁচ খিলানের সাবেকি ঠাকুরদালান ও কারুকার্য করা গ্যাসবাতির দিকে...যা বয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় আড়াইশো বছরের ঐতিহ্য। আড়াইশো বছর ধরে পুজো হয়ে আসছে বৈষ্ণবদাস মল্লিক বাড়িতে। 
বৈষ্ণবদাস মল্লিক বাড়ি ও ঠাকুর দালান

দেবী এখানে দশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী নন, সপরিবারে শিবদুর্গার অধিষ্ঠান। দেবীর এক অন্য মৃন্ময়ীরূপ নিয়ে শোনা যায় এক গল্পকাহীনি। বৈষ্ণবদাস মল্লিকের দেবীর অসুরদমনীরূপ পছন্দের ছিলনা, নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব হওয়ার দরুণ তিনি দেবীকে এক শান্ত রূপে দেখতে চেয়েছিলেন। এই সময়েই তিনি তাঁর স্বপ্নে দেখা কল্পিতরূপ দেবীরূপ জানান মৃৎশিলপীকে ও মৃৎশিল্পীও সেইরূপ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গঠন করেন, ইতিহাসের সাথেই বর্তমানেও মায়ের এই রূপই পূজ্য মল্লিক বাড়িতে। এখানে শিবের কোলে দুর্গার অধিষ্ঠান, দেবীর পায়ের কাছে আছে দুটি সিংহ। লক্ষী ও সরস্বতী দেবীর চেয়ে আকারে বড়ো এবং গণেশের হাতে অস্ত্র নেই বদলে আছে পদ্মফুল। এ বাড়ির প্রতিমার আরো এক আকর্ষণ তার বর্ণময় চালচ্চিত্র, চালচ্চিত্রের ঠিক মাঝে আঁকা হয় মহিষাসুরমর্দিনীন দুর্গাকে... 
মল্লিক পরিবারের দুর্গাপ্রতিমা

এই বাড়ির পুজোয় অন্নভোগের প্রচলন নেই কিন্তু লুচি, ভাজা, খাজা, গজা, বালুসাই ইত্যাদি ভোগ স্বরূপ দেবীকে অর্পন করার প্রচলন রয়েছে। ধুনোপোড়ানো এই বাড়ির এক বিশেষ রীতি, যেখানে বাড়ির মহিলা সদস্যরা মাথায় ও হাতে জ্বলন্ত মালসা নিয়ে পরিবার ও সন্তানের মঙ্গলকামনায় প্রার্থনা করে থাকেন।

মল্লিক পরিবারের ঠাকুর দালান



আমরা পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিট খুঁজছিলাম খেলাত ঘোষের বাড়ি খুঁজব বলে, রাস্তায় যেতে যেতে ডান হাতে এক বাড়ি পড়ল, যেখানে লেখা হরকুটির। একটি বাচ্ছাছেলে দাঁড়িয়ে ছিল সামনে, জিজ্ঞেস করলাম, “এই পুজো হয় এখানে?” বাচ্ছাছেলেটি দুষ্টুমি করে একবার বলে হ্যাঁ একবার বলে না! আমরা নিজেরাই বাড়ির ভেতর  ঢুকে দেখি সে এক মস্ত ঠাকুর দালান...


) হরকুটির রায় ব্যানার্জি বাড়ির দুর্গাপুজো
৫৩ পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০৬

২৮৫ বছরের পুরোনো দুর্গাপুজো তাদের এমনই জানিয়েছিল ঠাকুরদালানের সামনে বন্ধুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি বংশানুক্রমে পুজো হয়ে আসছে, এখন ধারকবাহক সে, পুজোর সময় বাড়িতে আসে...বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ উৎসবে যোগদান করে তাদের বাড়ির কাঠামো ৩০০ বছর পার করেছে, সুতানুটি গ্রাম থাকার সময় এই বাড়ি ছিল মাটির গঠনেরধ্রুপদ ঘরানার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত- স্কলার হিসেবে পরিচিত বিখ্যাত ছিলেন হরপ্রসাদ রায় ব্যানার্জী যার নামে এই বাড়ির নাম হরকুটির এই বাড়ির পুজোয় বলি-এর রীতি নেই শান্তিপুর নিবাসী মৃৎশিল্পী প্রতিমা গঠন করেন, বংশপরম্পরায় তারা প্রতিমা গঠনের কাজ করে আসছেন
হরকুটিরের ঠাকুর দালান

হরকুটির-এর দুর্গা প্রতিমা



এরপর আমরা খেলাত ঘোষ পরিবারের দুই ঠাকুর দালানে পৌঁছাই, তখন শহরে ইতিমধ্যে বিকেল নেমে এসেছে। লোকজনের অল্প ভিড়। আমাদের ক্ষিদে পেয়েছিল ভীষণ, খেলাত ঘোষের ঠাকুর দালানে বসে থাকার সময় একটি ছোট্ট ছেলে এসে প্যাকেটে করে প্রসাদ দিল, আমাকে ফেলেই আমার বন্ধু খেয়ে নিয়েছিল তখনও আমি ছবি তুলছি, এরপরে আরো একটু প্রসাদ বাড়ির জন্য নিয়েছিলাম তাঁদের থেকে।

) খেলাত ঘোষের বাড়ির পুজো
৪৭, পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিট, নর্থ কলকাতা
কলকাতার দীর্ঘতম ঠাকুর দালানেগুলির মধ্যে খেলত ঘোষের ঠাকুর দালান একটি মার্বেল বাঁধানো একটি বড় ডান্সহল সেখানে আছে, যা বর্তমানে খেলাত ঘোষমেমরিয়াল হল নামে পরিচিত বড় ব্যবসায়ী হওয়ার পাশাপাশিও খেলাত ঘোষ সমাজসেবী কালচারাল অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচিত
খেলাত ঘোষ ভবন ও ঠাকুর দালান

খেলাত ঘোষ পরিবারের দুর্গা প্রতিমা



খেলাত ঘোষের বাড়ির পাশেই ঘোষ পরিবারের আর এক ঠাকুর দালান রয়েছে,
) খেলাত ঘোষের পাশে বাড়ির পুজো
পাথুরিয়া ঘাটা স্ট্রিট, খেলাত ভবনের পাশে

প্রচলিত একই ঘোষ পরিবারের দুই বাড়িতে দুই ভিন্ন ঠাকুর দালানে দেবীকে পুজো করা হয় খেলাত ঘোষের মত বিশাল সুসজ্জিত ঠাকুর দালান না থাকলেও একইরকম ভাবে বনেদিপুজোয় নজর কাড়ে পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের ঘোষ পরিবারের এই ঠাকুরদালানটি তার প্রতিমার রূপ

খেলাত ঘোষ পরিবারের দ্বিতীয় ঠাকুর দালান

ঘোষ পরিবারের দুর্গাপ্রতিমা



খেলাত ঘোষের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা বিডন স্ট্রীট দিয়ে হাঁটতে থাকি, আমার কুলফি খেতে গিয়ে পরে যায় বলে খুব মন খারাপ ছিল, যাত্রা পাড়ার ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটি, দেওয়ালে যাত্রার পোস্টার...রাস্তা পেরিয়ে আমরা আসি ছাতুবাবু ও লাটুবাবুর বাড়ি...

) ছাতুবাবু লাটুবাবু বাড়ির পুজো
রামদুলাল নিবাস, ৬৬এ বিডন স্ট্রিট, উত্তর কলকাতা (শোভাবাজার মেট্রোস্টেশনের কাছে)

রামদুলাল দেব অর্থাৎ যাঁর নামে রামদুলাল নিবাস , মনে করা হয় তিনি বাংলার প্রথম কোটিপতি ব্যবসায়ী যিনি  মার্কিনীদের সাথে প্রথম বাণিজ্য শুরু করেন এবং অতি দরিদ্র পরিবার থেকে নিজ যোগ্যতায় ঐতিহ্য স্থাপন করেন১৭৭০ সাল থেকে এই পুজো হয়ে আসছে এখনোতাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র  আশুতোষ দেব প্রমথনাথ দেব যাঁরা ছাতুবাবু লাটুবাবু নামে পরিচিত তাঁরা এই পুজোর অধিকারী হন এবং বংশ পরম্পরায় পুজোয় ঐতিহ্য মান একইরকম রয়েছে
ছাতুবাবু ও লাটুবাবু-এর বাড়ি (রামদুলাল নিবাস)

সিংহবাহিনী নন, এখানে দেবী ঘোড়ার পিঠে অবস্থান করেনএইবাড়ির পুজোয় দেবীর পাশে লক্ষী সরস্বতী থাকেন না, থাকেন দেবীর দুই সখীপদ্মের উপর থাকেন জয়া বিজয়াপুজোর আগে নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর নিয়ম ছিল এই বাড়িতে, নীলকণ্ঠপাখি নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে পায়রার গায়ে নীল রঙ করে ওড়ানো হত এখন সেই প্রথাও বন্ধবাড়ির মহিলারা নিজ হাতে কুমারী পুজো করেনসুন্দর ঝাড় বাতিসজ্জিত ঠাকুর দালান নজর কাড়ে সকলের...
ছাতুবাবু ও লাটুবাবু বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা


তখন শহরে সন্ধে, আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলছি বারবার কিন্তু ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছিনা নবমীর মত। রস্তার ধারে, বাড়ির গায়ে আলো জ্বলছে...আমরা একই রাস্তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি, কিন্তু মিত্র বাড়ি খুঁজে পাচ্ছিনা একসময় এক গলির ভেতর দিয়ে এসে আমরা মিত্রবাড়ির ঠাকুরদালানে পৌঁছাই, জানতে পারি এটি দুর্গাচরণ মিত্রের দুইনং ঠাকুরদালান, পাশের গলিতেই রয়েছে আর একটি ঠাকুরদালান...

৯)ক) ও খ) দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ি
১৯ নীলমণি মিত্র স্ট্রীট এবং ৪২ বিডন রো, উত্তর কলকাতা

২০০ বছরেরও পুরাতন মিত্রবাড়ির পুজো। পিতৃপুরুষ দুর্গাচরণ মিত্র ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সভার মণিকার। এখানে দেবী সিংহবাহিনী নন, ঘোড়ার উপরেই তারঁ অধিষ্ঠান। পদ্মফুলের বদলে অপরাজিতাফুল দিয়ে সন্ধিপুজো হয়। একসময় পশুবলির প্রচলন থাকলেও এখন দেবীকে উৎসর্গ করা হয় বাটি ভর্তি চিনি। দশমীতে ঠাকুর বরণ ও কণকাঞ্জলির পর বাড়ির মেয়েরা একবার দেবীর সিংহাসনে বসেন, রীতি অনুযায়ী মনে করা হয় এতে দেবীর শক্তি তাঁদের মধ্যে সঞ্চারিত হবে। দর্জিপাড়ার দুর্গাচরণ মিত্রের তিনটি ঠাকুর দালান ছিল, বর্তমানে দুটি ঠাকুরদালান দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে একটি দালান বৃহৎ ও সুসজ্জিত এবং আর একটি তুলনামূলক ক্ষুদ্র...পুজো হয় দুই দালানেই। বংশানুক্রমে পুজো হওয়ার সাথে সাথে পুজোর দায়িত্বে থাকা পরিবার, অর্থাৎ ভোগ রান্না ও অন্যান্য কাজ-এর দায়িত্বে থাকা পরিবার বংশানুক্রমে এই কাজ করে আসছে। দুটি দালানের ঠাকুরের ছবি রইল।
দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ির দ্বিতীয় ঠাকুর দালান

দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ির দ্বিতীয় ঠাকুর দালানের তিন চালার ঠাকুর



দর্জিপাড়ার মিত্র বাড়ির প্রথম ঠাকুর দালানের তিন চালার ঠাকুর

দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ির প্রথম ঠাকুর দালান

এবং গতবারের স্মৃতি থেকে রাসমণির বাড়ির কথা লিখলাম, সেবার অষ্টমীতে খুব বৃষ্টি নেমেছিল, সেই বৃষ্টির কথা সেই ভিজে যাওয়ার কথা ভোলার নয়ই, এস্প্ল্যাণেড মেট্রো স্টেশনের কাছে রাসমনির জানবাজারের কাছাড়ি বাড়ি।

১০) রাণী রাসমণি বাড়ির দুর্গাপুজো
১৩, রাণী রাসমণি রোড, ১৮/ এস এন ব্যানার্জি রোড,

দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির প্রতিষ্ঠাতা রাণী রাসমণি তাঁর বাড়িতে এই দুর্গাপুজো প্রথম শুরু করেন, ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা জামাতারা এই পুজো উৎসব বন্ধ করেননি, তাঁর বসত গৃহে জানবাজারে বংশ পরম্পরায় এখনও পুজো হয় এটি আসলে তাঁর কাছাড়ি বাড়ি ছিল, এর বিপরীতেই বিশাল রাণী রাসমণি ভবনে দুর্গাপুজো হয়, যা বিশ্বাস পরিবার দ্বারা পরিচালিত রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও এই দেবীর পুজো করেছেন একসময়ে...

রাণী রাসমণির বাড়ির প্রতিমা




সেদিন মিত্তির বাড়ির ঠাকুর দালান থেকে বেরিয়ে আমরা গল্প করছিলাম নিজেদের মধ্যে, আমি বলেছিলাম, “জানিস আমার কিরম মনে হচ্ছে, যেন আমি আর একবিংশতে নেই হয়তো প্রায় দুশো বছর আগেই ফিরে গেছি। আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে সেইসময়টা যখন এইবাড়িগুলোর পুজো শুরু হয়েছে সবে সবে, তখন এই রাস্তাটা কেমন ছিল কে জানে? ইশ যদি একটা টাইমমেশিন থাকত!” সে বলেছিল, “আমরা তো টাইম ট্রাভেলই করছিলাম!” হাঁটতে হাঁটতে আমরা বড় রাস্তায় এসে পড়লাম, পাঞ্জাব হিন্দু হোটেল থেকে খেলাম বিরিয়ানি, ক্ষিদে পেয়েছিল তো ভীষণ! পুজোর আর একটা রাত বাকি, তারপর এই এত অপেক্ষা এত  পরিকল্পনা সব গতরাতের স্বপ্নের মত উবে যাবে। এত মন খারাপ হয়তো আগে কখনো হয়নি,  শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের দিকে আসতে আসতে রাস্তার আলোগুলো ঝাপসা লাগছিল কেবল, মেট্রোস্টেশন থেকে বেরিয়ে অনেক মানুষ ভিড় করে উত্তর কলকাতার ঠাকুর দেখতে এসেছিল। আমি পিছু ফিরে তাকাচ্ছিলাম কেবল, এতক্ষণ যে সময়টা সাথে ছিল, এতক্ষণ যে রাস্তায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম বারবার আর একবার ফিরে যাওয়া আয় কি সেখানে? “হুম যায় তো আসছে বছর আবার, এ রাত্রিই উৎসবের অন্তিম রাত্রি নয়তো!” কানে কানে কে যেন বলে চলে গেল। আমরা মেট্রো স্টেশনে ভিড় ঠেলে টিকিটের লাইনে এসে দাঁড়ালাম, আমার মনে হচ্ছিল মেট্রো স্টেশন ধুনোর ধোঁয়ায় ভরে আছে, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেই দেখতে পাব দুর্গা ঠাকুর...লাল সাদা শাড়ি পরা মেয়েরা সাদাপাঞ্জাবির হাত ধরে হেঁটে হেঁটে বেড়াচ্ছে! ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে উঠে বসছে শহর সারারাত জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে...মেট্রো এলো, আমরা মেট্রোয় উঠলাম। দুজনেরই ভীষণ মনখারাপ, আমার পাশ দিয়ে সময় এগিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। আমি হাতের মুঠোয় পুজোর স্পর্শ পেলাম, মুঠো খুলে দেখি, এক গুচ্ছ সদ্যপ্রস্ফুটিত শিউলিফুল! চোখ বন্ধ করে দেখেছিলাম, আমরা হারিয়ে যাচ্ছি আর ফিরে পাচ্ছি নিজেদের এক বনেদি বাড়ির ঠাকুর দালানেই...


এই ছবিটি সৌজন্যে - গুগল

বিশেষ কৃতজ্ঞতা -  Durga Puja of Bonedi Families at Kolkata - Amitava Gupta
                                 Ebela.in ও তাঁদের যাঁরা সেদিন রাস্তায় পথ চিনিয়েছিলেন এবং আমার বন্ধুকে যে না থাকলে এই লেখাটি সম্পূর্ণ হতনা। অনেক ধন্যবাদ এমন একটি দিন উপহার দেওয়ার জন্য...

instagram link : 
https://www.instagram.com/buno_ful/

1 comment:

  1. Indrani prochondo valo hoyeche. Protiti pujoy ekta kore j unique information diyechis seta master stroke.

    ReplyDelete