আমার অনেকদিন
হলে ছবি দেখতে যাওয়া হয়না। আমার বন্ধুরা অনেকেই নতুন ছবি দেখে ফেলে আমি ফেসবুকে তাঁদের স্টেটাস দেখি কিন্তু আমার নতুন ছবি দেখা হয়না,
ঐ ঘরে বসে যেক’টা ছবি দেখি!
আজ-এর আগে আমি আসামের ছবি দেখিনি, ‘ভিলেজ রক্সটার’-এর স্ক্রিনিং যখন শহরে হচ্ছে সেই
ক’দিনের মধ্যেও আমি ছবি দেখতে যেতে পারিনি। আজ একটি ছবি দেখলাম, “মাজ রাতি কেতেকি”।
Santwana Bardoloi পরিচালিত ২০১৭
সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অসমীয়া ভাষার ছবি। ‘মাজ রাতি কেতেকী’ নিয়ে দু’চার কথা লিখব, আমি
জানিনা আমার ফ্রেন্ডলিস্টে কতজন ছবিটি দেখেছেন বা ছবিটির সম্বন্ধে জানেন , এই
ছবিটি শ্রেষ্ঠ অসমীয়া ভাষার ফিচার লেন্থ ছবিস্বরূপ জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত। জাতীয়
পুরষ্কার প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা নয়, ছবিটির প্রতি আমার ভাল লাগা নিয়ে আলোচনা করব।
‘মাজ রাতি কেতেকি’-এর মুখ্য চরিত্র একজন
লেখক প্রিয়েন্দু হাজারিকা যিনি
তাঁর উপন্যাসের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পান, পুরস্কার প্রাপ্তির পর তিনি গৌহাটি ফেরেন। ছবিটি আমাদের দুটি সময়রেখা দেখায়, দুটি
ভিন্ন সময়রেখায় আমরা কয়েক জীবনের ছবি দেখি। এখানে প্রত্যেক চরিত্রের একটা
স্বপ্ন আছে, ওঁরা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে! প্রিয়েন্দুকে এয়ারপোর্টে পিক আপ করতে আসে
সুমোনা, যে একটি উপন্যাস লিখেছে আর স্বপ্ন দেখছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসটি
প্রকাশিত হবে...স্বপ্ন সফল করার জন্য প্রকাশকের যাবতীয় কাজ করে দিচ্ছে...সুমোনার
মাঝেমধ্যেই ফোন আসে, আমরা জানতে পারি সুমোনার বাবা অসুস্থ। সুমোনা রাস্তা পার হয়,
শহরে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসে... প্রিয়েন্দুর নস্টালজিয়া ছবির আর এক সময়রেখা,
না! ঝকঝকে সাজানো স্মৃতি নয় বরং সেই স্মৃতি
যেখানে প্রবঞ্চনা আছে, আছে মৃতুও…বিখ্যাত লেখকের বর্তমান জীবনছবি দেখতে দেখতে ফিল্মটি
স্মৃতির পাতা উল্টায় আমরা দেখতে পাই, গাছের নিচে জলের উপর একটি নৌকা ভাসছে তাতে শুয়ে
আছে একটি ছোট্ট ছেলে, রোদ্দুর এসে পড়ছে পাতার আড়াল থেকে, এই দৃশ্যাংশই এক কবিতা
হয়ে যাচ্ছে পরের দৃশ্যে। তাদের
গ্রাম চিত্রকলার মত সুন্দর, গ্রামে দুঃখ আছে, গ্রামে বৃষ্টিও
আসে আবার শীতের সময় হাফহাতা সোয়েটার পরে এক বৃদ্ধ মনের দুঃখে
হারিয়ে যেতে চায়! তিনি তাঁর বিদেশবাসী ছেলের ফেরার অপেক্ষা করেন। গ্রামের মানুষদের বলেন, আমার ছেলে ক’দিন পরেই ফিরবে আমিও আমার
ছেলের সাথে আমেরিকা চলে যাব। দুপুরবেলা তিনি গ্রামের ছোট্ট দুই ছেলে
প্রিয়েন্দু ও তাঁর বন্ধু ভোলার
সাথে লুডো খেলেন আর স্বপ্ন
দেখেন তার ছেলে পরিবার নিয়ে ফিরে এসেছে।
ভোলা প্রায়ই স্বপ্নে দেখে দড়িতে
মেলা একটি লালপাড় সাদা শাড়ি উড়ছে, ভোলা প্রতিরাতে স্বপ্নে তাঁর মায়ের কাছে ফিরে
যায়। মামাবাড়িতে সবকাজ করে দেয় বদলে মামা ভর্তি করে দেয় ভোলাকে, ভোলার পায়ে গরম চা
পড়ে যায় কিন্তু ভোলা কারোর প্রশ্নের উত্তর দেয়না। ছোট্ট প্রিয়েন্দু প্রতিদিন একটা
করে টাকা জমায়, তাঁর স্বপ্ন সে ব্যাট কিনবে খেলবে বড় ক্রিকেটার হবে। প্রিয়েন্দুর
পরিবার স্বপ্ন দেখে এই মাসটা তাদের অর্থাভাব থাকবেনা কেটে যাবে ঠিক... অথচ সবার
স্বপ্ন ভেঙে যায়ই, হয়তো স্বপ্ন গড়েই ভাঙার জন্য। ভোলা এক মাঝির সাথে পালিয়ে যাবে
ভাবে, সেই মাঝি তাকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেবে। নিজের বন্ধুকে অকারণে মার খেতে
দেখে নিজের স্বপ্ন ভেঙে ব্যাট কেনার জন্য জমানো পয়সা প্রিয়েন্দু পৌঁছে দেয় ভোলার
কাছে যাতে ভোলা পালিয়ে যেতে পারে! প্রিয়েন্দুর দাদা নিজের ভালো ফলাফলের পরও শহরের
কলেজে পড়তে না গিয়ে গ্রামে উচ্চশিক্ষার কথা ভাবে কারণ সে একজনকে কথা দিয়েছে তার
সাথে থাকার স্বপ্ন দেখে! ফিরে আসেনা বৃদ্ধের ছেলে, প্রিয়েন্দুর ব্যাট কেনা হয়না...
প্রিয়েন্দুর দাদা বোঝে কথা দেওয়া হয় কথা না রাখার জন্য। ভোলারও মায়ের কাছে ফেরা
হয়না, তার দেহ নদীর জলে ভাসতে ভাসতে অনেকদূর পৌঁছে যায় যেখানে আর কোনো যন্ত্রনা
নেই। কত স্বপ্ন মুহূর্তে ভেঙে যায়, স্বপ্নকাতরদের ঘরে ফেরা হয়না অথচ ওদের গ্রামের
আকাশে রঙবেরঙের ঘুড়ি ওড়ে। আমরা নদীর পাড়ে এসে বসি কখনো, কখনো গ্রামের রাস্তা দিয়ে
হেঁটে ছুটে বেড়াই ওদের সাথে , কখনো বৃদ্ধের অকারণ হারিয়ে যেতে চাওয়ার অর্থ খুঁজি...যেন
উপন্যাসের একএকটা পাতা উল্টাই, যার প্রত্যেক পাতায় আসামের এক ছোট্ট গ্রামের
প্রকৃতির নিখুঁত বর্ণনা দেওয়া আছে। কখন সেখানে রোদ্দুর এসে পড়ে বারান্দায়, কখন
বৃষ্টির মধ্যে ঠেলাগাড়িতে পথ চলে মুমূর্ষের। হয়তো আমরাও অনেকবছর পরেও নদীর পাশে
চুপ করে বসে থাকি লেখক প্রিয়েন্দুর সাথেই, মন খারাপ এবং অভিমানের কবিতা পাঠ করি।
ছবিতে একটি গান আছে, ওটিও আজ থেকে আমার এক প্রিয় গানই!
No comments:
Post a Comment