অতঃপর প্রেম আসে নিভৃতে, নিঃশব্দে। সমস্ত ওলট
পালট করে দিয়ে নীরবে বসত করে আমাদের ঘরে। সেই ঘরের বারান্দা কখনো শরতের শিউলিফুলের গন্ধে মম করে, কখনো বৃষ্টির
জলে মেঝে ভিজে যায় কিংবা শীতের পাতাঝড়া উদ্ভিদ সেই বারন্দার পাশটায় বছরভর বড়ো হয়…অপেক্ষা করে
বসন্তের। সেই ঘরের
জানলায় ভালোবাসার লতানো গুল্ম বেড়ে ওঠে…সাক্ষী থাকে এসব কিছুর!
ড্যান(অভিনয়ে বরুন ধাওয়ান) এবং শিউলি
(অভিনয়ে- বনিতা) দিল্লীর একটি হোটেলে ট্রেনি হিসেবে জয়েন করে। দুজনের
মধ্যে সেরূপ কোনো আলাপচারিতা ছিলনা, ছবির শুরুতে প্রধান দুই চরিত্রের আলাদা করে
কোনো ইন্ট্রোডাকশানও হয়নি। ছবিতে দুটি আলাদা মানুষের মধ্যে ভালোবাসার বীজ আগেই বপণ হয়েছিল কিনা তার কথাও
আমরা জানতে পারিনা। ড্যান এমন একটি ছেলে যে তার কাজ নিয়ে খুব একটা সিরিয়াস না, তার
ভুলের জন্য তাকে প্রায়ই শাস্তি পেতে হয় আবার অনেক সময় মুখ ফস্কে ভুলভাল কথাও বলে
ফেলে। আগেপিছু কোনো টান নেই, পাখির মত একটা সত্ত্বা হল ড্যান।
আর শিউলিকে যদি তার
বিপরীতটাই মনে করে নেওয়া যায়? একটি মেয়ে যে প্রকৃতির মত, সবুজের সাথে মিশে থাকে।
কাজের ক্ষেত্রে সবসময় বুদ্ধির পরিচয় দেয়।
এরমধ্যেই শীত আসে, বারন্দার পাশে বাড়তে
থাকা গাছটার পাতাগুলো হঠাতই ঝড়ে পরে যায়। নিউ ইয়ারস ইভ-এ অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যায়,
মুহূর্তে ওলটপালট হয়ে যায় সবকিছু... কারণ প্রেম আসে নিঃশব্দে, আমাদের জানিয়ে
আসেনা, জানিয়ে আসেনা শিউলি ও ড্যানকেও। আইসিইউ-তে পাথরের মত শুয়ে থাকে
শিউলি...শরীরে তথাকথিত সোউন্দর্য নেই, শুধু আছে গাঢ় নিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকা একটা
সত্ত্বা। যে চোখ মেলে চায়না, উত্তর দেয়না। পাশে চলতে থাকা স্ক্রিনটা জানান দেয়
কেবল, একটা প্রাণের অস্তিত্ব আছে। যে প্রকৃতির মত, যে প্রকৃতির সাথে মিশে থাকে।
শরতের ভোরে সবুজ ঘাসের উপর বিছিয়ে থাকা শিউলিফুল কুড়িয়ে আনে, ওদের আলতো হাতে
স্পর্শ করে ভালোবাসে। ডাক্তার শিউলির মা’কে মস্তিষ্কের ছবি দেখিয়ে কিসব বোঝায়
কিন্তু আমি সেসবের দিকে অত মন দিইনা আমি মন দিই ডাক্তারের ডেস্কে আটকিয়ে থাকা সাদা
কাগজের দিকে, যেখানে লেখা আছে “বসন্ত”। আর আমি মনে ভেবেছি আমার বারন্দার পাশে
বাড়তে থাকা গাছটার কথা যে গাছটা থেকে সমস্ত পাতা ঝড়ে গেছে। আমার সেই গাছটা যখন
স্বপ্ন দেখে, দেখে এক রঙিন বসন্ত। বেশ কয়েকটা গাছের নিচে একটা বেঞ্চ পাতা, গাছের পাতার
রঙ উজ্জ্বল, উষ্ণ। হ্যাঁ অভীক মুখোপাধ্যায়ের সিনেমাটোগ্রাফি এইভাবেই প্রকৃতির নানা রঙকে পর্দায় এঁকে
ফেলে। শীতের রুক্ষতা
সত্যিই পার করে বসন্ত আসে, শিউলি গভীর ঘুমের থেকে চোখ খুলে তাকায়, তার চোখের
মণি সবকিছু দেখে কিন্তু প্রকাশ করতে পারেনা।
কাল অবধি ড্যান যে মানুষটার কেবল পরিচিত ছিল , এখন তার কাছে
আসাটা ড্যানের অভ্যেসের মধ্যে পরে। সারারাত তার পাশে বসে থাকে, প্রয়োজনে ওষুধ আনতে যায়। ড্যান একাই কথা বলে, শিউলি কোনো
উত্তর দেয়না…শিউলির নীরবতাকে মনমত সাজিয়ে নেয় সে। শিউলির থেকে তার কিছু পাওয়ার নেই, নিথর শরীরটার
মধ্যে যে একটা প্রাণ আছে সেটাই তার কাছে যথেষ্ট। ড্যান সেই প্রাণের অস্তিত্বের অভ্যেস করছে। আইসিইউ-এর শীতলতায়
প্রেম আস্তে আস্তে নিজের শিকড় ছড়িয়ে দেয়। এরপর বর্ষার জল গাছের পাতা দিয়ে গড়িয়ে পরে, ড্যান আর
শিউলির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। কারণ বর্ষা যে শুধু ভালবাসার কবিতা লেখেনা, শব্দ গড়ে
মন কেমনেরও। শিউলির অভিমান
হয়, অদ্ভুত এক অভিমান , যে অভিমান জানলার ধারে বসে থাকে চুপচাপ কেবল বৃষ্টি পরা দেখে
আর ফুলের পাপড়ি থেকে বয়ে আসা জল বৃষ্টির মত দেখায়।
ডাক্তার ড্যানকে বোঝায়, আমাদের স্বত্তাই
সর্বস্ব, যে সচেতন থাকে। দুটো মানুষ দুটো মানুষের প্রেমে পরে অজান্তেই, আসলে বোধ
হয় ওরা অভ্যেসের প্রেমে পরে কিংবা অস্তিত্বের। একবিংশে আমরা যখন কেবল ‘আদান-প্রদান’ এর সম্পর্কে
বিশ্বাস করি, আমরা স্পর্শকেও কর্পোরেট করে ফেলি, আমরা খুঁজে
ফিরি স্যাটিস্ফেকশন তখনই জুহি চতুর্ভেদি দুটি স্বত্বার মধ্যে এক আত্মিক(স্পিরিচুয়াল) যোগ স্থাপন
করেন। সম্পূর্ণ
স্ক্রিনপ্লে জুড়ে কেবল বিশ্বাস ও অপেক্ষা। ঋতুর সাথে ভালোবাসার রঙ বদলায়। কখনো শরতের শিউলিফুলের নরম পাঁপড়ি সে গালে ছুঁইয়ে দেখে, কখনো শীতের
ঝড়াপাতা গাছ স্বপ্ন দেখে রঙিন বসন্তের। এক অমলিন বিকেলবেলার স্বপ্ন, স্বপ্নে অনেক
অনেক গোলাপি কাগজফুলেরা ঘুমের পর চোখ মেলে বর্ষাকে চিঠি লিখেছে। চিঠিতে লিখে
পাঠিয়েছে অভিমানের কথা। আমিও এই ভালোবাসাকে খুঁজে ফিরছি বছরভর আর ওদিকে ড্যান আর শিউলি পৃথিবীর সব বাধাকে
অতিক্রম করে ফেলেছে…হুম! অতিক্রম করে ফেলেছে মৃত্যূকেও। কারণ, সম্পর্ক দুটো আত্মার মধ্যে গড়ে ওঠে। আমি চোখ বুজে দেখতে পাই, এক পাহাড়ি
নদীর পাশে সবুজের উপর ড্যান ও শিউলির ভোরবেলায় দেখা হয়। গাছ থেকে সদ্য ঝরে পরা শিউলিফুল মাটির উপর বিছিয়ে থাকে। শিউলি ফুল
কুরিয়ে নেয়, ড্যানকে বলে, “শিউলিফুলের জীবনসময়
খুব স্বল্প!” নদীর জল ওদের পা ছুঁইয়ে যায়। আর আমার বারান্দার পাশে বেড়ে ওঠা গাছটায় দেখি ফুল এসেছে শরতের। গাছের নিচে
অজস্র শিউলিফুল বিছিয়ে রয়েছে, একটা ফ্রক পরা ছোট মেয়ে দাদুর সাথে ফুল কুড়োচ্ছে।
মেয়েটি আমার
খুব চেনা, আমি বারন্দা থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকি, চোখ থেকে
জল গড়িয়ে পরে। আমার জনালায় ভালোবাসার লতানো গুল্ম আপন মনে বেড়ে চলে। আমি এক টুকরো শিউলি গাছ ড্যান-কে দিই, ড্যান গাড়ি
করে গাছটি নিয়ে চলে যাওয়ার সময় এক অপেক্ষার চিঠি লেখা শুরু করে যার ভীষণ দুঃখ, কারণ শিউলির
সাদা পাঁপড়ি কেমন রক্তময়।
No comments:
Post a Comment