HAPPY READING...


Friday, 29 July 2016

অবৈধের কাব্যপোন্যাস : ক্ষত

পরিচালক- কমলেশ্বর মুখার্জী।
কাস্টিং-  প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়, পাওলি দাম, রাইমা সেন, ত্রিধা চৌধুরি, রণদীপ বসু এবং অন্যান্য।

এমন এক অ্যাটস্মোফিয়ারে প্রতিনিয়ত আমাদের শ্বাস বায়ু ঘোরাফেরা করে, যেখানে শ্বাসবায়ুকেও খেয়াল রাখতে হয় হুটপাট কোনো ‘অস্বীকৃত’ মন্তব্য না করে ফেলে! থাকে চিন্তাভাবনার ওপরেও কড়া নজরদারি। নজরদারির মুখ্য আসনে পায়ের ওপর পা তুলে দিব্য বসে থাকে একজোড়া চোখ! সব সময় নজর বোলাতে থাকে সেইসব শব্দের লিস্টে, যে শব্দগুলো কখনোই জনসম্মুখে বলা উচিৎ নয়! এই একজোড়া চোখ,যার অধিকর্তা সিস্টেম, কিংবা মেজরিটি? আচ্ছা এই সিস্টেমকেই যদি একটা শরীর হিসেবে ভেবে নিই; তাহলে তারও আর চার পাঁচটা মনুষ্য শরীরের মত আছে হাত,পা,চোখ,নাক, মুখ ইত্যাদি এবং ক্ষিদে, রাগ, ঘেন্না, আনন্দ, দুঃখের মত বেসিক কিছু অনুভুতি। ‘কখনো প্রকাশ করা উচিৎ নয়’ লিস্টিকে যদি সঙ্গে করেই এই একই লাইন আবার লিখি? তবে দাঁড়ায় এই শরীরের ও হাত ,পা, চোখ, নাক,মুখ এবং  আছে যৌনাঙ্গ! আনন্দ,দুঃখের মত যৌনতাতেও সমান গুরুত্ব দিতে হয়, বলা উচিৎ দিতেই হয়! পার্থ্যকটা চিন্তাভাবনার সেনসরড ও আন সেনসরড ভার্সানে! যেটা আমি ভাবছি সেটা প্রকাশ করতে পারব কিনা তার জন্য চেয়ে থাকতে হয় নজরদারির সেই অধিকর্তার দিকে! এক ধরণের চলতি জড়তা!

‘ক্ষত’ এমন একটি ছবি যা নজরদারির অধিকর্তার ছড়ির আঘাতের দাগ পিঠে নিয়েও চলতি জড়তাকে কাটিয়ে উঠে সহজ সত্যগুলো বলে, শরীরের সত্যগুলো বলে, চাহিদার সত্যিগুলো বলে, সেক্স ইস আ বেসিক নীড! বয়ঃসন্ধিক্ষন থেকে ক্ষিদে,আনন্দ, দুঃখ ছাড়াও ‘যৌনতা’ নামক যে অনুভূতিটিকে শরীর লালন-পালনের দায়িত্ব নেয়, সেই সত্যিটি সবার সামনে বলার আগেই যেন মনে হয় হাজার দুটো চোখ ভাবনা প্রকাশের দিকে রূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, গন্ডিবদ্ধ মস্তিষ্ক বারবার রিমাইন্ডার দিতে থাকে ‘সেক্স’ শব্দটি হুটপাট অটো,বাস-এ কিংবা লোকালয়ে উচ্চারণ করতে নেই। পাশাপাশি একথাও সত্য যে মধ্যবিত্ত বাঙালি কাপেল-এর বন্ধ দরজার ওপাশের প্রাইভেসি আড্ডার আলোচনা, হাসির খোড়াক হয়ে ওঠে।

যে রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন হাঁটাচলা করতে হইয়...সেখানে ফোনের ওপাশে গার্লফ্রেন্ড থাকলেও চোখজোড়া অটোয় বসা অচেনা সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে থাকে, কিংবা পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ‘ডবকা’ মেয়েটির দিকে! প্রেমিকা বা স্ত্রী-র স্তন ছোঁয়া হাত ইচ্ছা করেই রাস্তার অচেনা মেয়ের স্তনে ঘষা খায়!(আমি জেনারেলাইসড করছিনা)...
নতুন ঠোঁটকে আপন করার সময় কি পুরাতন ঠোঁটজোড়ার স্বাদ মনে পড়েনা? হয়তো পড়ে কিন্তু কেউ প্রকাশ করিনা। সেইক্ষেত্রে নির্বেদ লাহিড়ী(অভিনয়ে-প্রসেন জিত চট্টোপাধ্যায়) যদি জানান, “ আমি তোমাকে ভালোবাসি সৃজিতা, কিন্তু আমি অন্তরাকেও চাই!” তবে তিনি কেন এক্সেপ্টেবল হতে পারলেন না? তাকে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যেতে হল? তিনি যদি জানান, “আই লাভ কার্ভস, আমি না দেখে থাকতে পারিনা!” তবেই তাঁর হাইএডুকেটেড স্ত্রী সৃজিতা (অভিনয়ে রাইমা সেন) তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে , “fuck your writings…fuck your characters!” তখনই তিনি সমাজের চোখে, মিডিয়ার ক্যামেরায় অস্বীকৃত? সিকনেস কোথায়, সিক কে? সিকনেস এক্সেপটেনসে, সিকনেস মানসিকতায়! আর পার্থক্য, পার্থক্য সাহসিকতায়, পার্থক্য প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্যে!

‘ক্ষত’-এর নির্বেদ লাহিড়ীর চরিত্রে অনেকগুলো শেড, অনেকগুলো রঙ! ভালোবাসার রঙ, রোমাঞ্চের রঙ, শরীরের রঙ, কালির রঙ,তবে সবই ‘লাল’…তাঁর জীবনে ঢেউয়ের রঙও লাল! তাঁর চরিত্রের সবকটি শেডের মধ্যে থেকেই তাঁর আচরণ, তাঁর সংলাপ নজরদারির আড়লে থাকা শরীরতুতো,বাসনাগ্রাহ্য সত্যিগুলোকে সরাসরি তুলে ধরে! তাঁর কামনা তাঁর শরীরের প্রতি ভালোবাসা,টান প্রকাশ্যে আসলেই তিনি পার্ভার্ট, আর যে মানুষটা ‘ভদ্রলোকের’ মুখোশ টেনে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে ভিড়ের সু্যোগে একজন মেয়েকে ক্রমাগত মলেস্টেশনের মাধ্যমে বিকৃত মানসিকতাগুলোকে উসুল করেন তিনি পার্ভার্ট নন?

অন্তরা(অভিনয়ে পাওলি দাম) কলেজ জীবনে তাঁর মাসতুতো ভাইয়ের প্রেমে পড়েছিল, লিটল ম্যাগাজিনের লেখিকা বিবাহিত জীবনে এসে তাঁদের সময়ের অ্ন্যতম লেখক ও তাঁর বন্ধুর হাসব্যান্ডের প্রেমে আবার পড়ে, তাই সে ব্লাডি বিচ!
আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটা বন্যজন্তু লুকিয়ে থাকে, নানাভাবে নানা ঘটনার মাধ্যমে তা প্রকাশ পায়। কোন মানসিকতা বেশি হিংস্র, নির্বেদ এবং অন্তরা যারা একে অপরের শরীরকে ভীষণ ভালোবেসেছিল তাঁরা, নাকি যারা তাদের অ্যাক্সেপ্ট না করে এক কোণায় ঠেলে দিল তাঁরা?

ছবির নানা দৃশ্যাংশের মাঝেমাঝেই পান্ডুলিপির ওপর রক্ত ঝরে পড়ে, ‘ক্ষত’-এর পান্ডুলিপি,আত্মজীবনির পান্ডুলিপি! লেখক বারেবারে পুড়িয়ে দেন তাঁর লেখা তাঁর সৃষ্টি! সারা ছবি জুড়ে শুধু ক্ষত। সিস্টেমের ছড়ির আঘাতের ক্ষত, ভালোবাসার ক্ষত! যাঁর পরিণতি মৃত্যু কিংবা মেন্টাল অ্যাসাইলামের বদ্ধ চার দেওয়াল। ইমোশান ও অনুশোচনাকে বাদ রেখে বাদবাকি ছবিটিতে দৃষ্টিপাত করলে স্বীকার করতেই হয় পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় নিজের সৃষ্টিকে চলতি বিশ্বাসে আটকে না রেখে “ক্ষত”-এর মত সাহসি পদক্ষেপ নিয়েছেন। এক আত্মজীবনীতেই সমস্ত রহস্য এবং রোমাঞ্চের ধারবাহিকতা। প্রেম, শরীর, থ্রিল… সম্পূর্ণ ছবিটি একটি কাব্যপোন্যাসের মত,ছবির চলন বলনে কাব্যনাটকীয়তা! যেমন-  নির্বেদের স্ত্রী সৃজিতা বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত জানানোর পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা লেখার কপির উপর নির্বেদ কুঁকড়ে শুয়ে কাঁদতে থাকে, দৃশ্যটি এক লেখকের ক্ষতের ক্থা বলে।

‘ক্ষত’-তে শব্দের ব্যবহার অসাধারণ লাগল। স্ক্রিনে কোনো ঘটনা দৃশ্যায়িত হওয়ার আগেই শব্দের উপস্থাপনা দর্শকমনকে রোমাঞ্চের পূর্বাভাস দেয়। একটি দৃশ্যে পালাম্যুর জঙ্গলে বৃষ্টি আসার আগে ‘মাঝে মাঝে তোমার পরশখানি দিও’-এর ইন্সট্রুমেন্টাল দৃশ্যজুড়ে রোম্যান্টিসিসমের সঞ্চার করে। সিনেমাটোগ্রাফি ‘ক্ষত’-এর অন্যতম আকর্ষন। ৯০-এর দশকের স্ময়কাল উপস্থাপনার ক্ষেত্রে একটু গড়মিল থেকে গেলেও সিস্টেমের রাখঢাক নজরদারিকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে ‘ক্ষত’-এর সাহসিকতা অনেক বেশি গ্রহনযোগ্য বলে মনে হয়েছে। আড়ালে আবডালে কেচ্ছাপ্রিয় বাঙালি মন ‘ক্ষত’-এর সোজাসাপটা বক্তব্যকে পার্ভার্ট বলে অ্যাক্সেপ্ট না করলেও, শরীরতুতো সত্যিগুলো সত্যিই থেকে যাবে, তা প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে!

ছবি সৌজন্যে : গুগল

1 comment: