পরিচালক- অনিরূদ্ধ রায় চৌধুরী
সিনেমাটোগ্রাফি – অভীক মুখোপাধ্যায়
এডিটর – বোধাদিত্য ব্যানার্জী
কাস্টিং – তাপসী পান্নু, অমিতাভ বচ্চন, কৃতি
কুলহারি, Andrea Tariang এবং অন্যান্য।
১) হাসীনা। ২০
এপ্রিল, ১৯৯৯
২) লক্সমী।
২০০৫
৩) অন্নু মুখার্জী।
১৯ ডিসেম্বর,২০০৪
৪) মীণা সোনি।
২০০৪
ভারতের অন্যতম চারজন ‘অ্যাসিড অ্যাটাক
ভিক্টিম’-এর উদাহরণ। আচ্ছা থাক অতবছর আগের জড়ো করা সহানুভূতিগুলোকে টেনে আনার দরকার নেই। কাছাকাছি ভাবি, গত
মঙ্গলবার সকালে একজন একুশ বছরীয় মেয়েকে দিল্লীর রাস্তায় খুন হতে হয়(A 21-year
old girl was allegedly stabbed to death 30 times in North Delhi on Tuesday
morning, NEW DELHI, TOI)। এছাড়াও আরো অনেক উদাহরণ নির্বিকারে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাদের একশো
বছর পরও গুগলে খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু একশো দিনের আগেই মানুষের সহানুভূতির তালিকায়
জায়গা করে নেবে নতুন কিছু ‘উদাহরণ’। এনলিস্টেড হওয়া অবধিই... কিন্তু সেই উদাহরণের
বিরূদ্ধে ঘুরে দাঁড়াব যে তার সাহস কোথায়? এইসব উদাহরণের দোষ একটাই ছিল, ওরা ‘না’
বলেছিল। ওরা না বলেছিল নিজের ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করতে, ওরা না বলেছিল
পুরুষতন্ত্রের বিরূদ্ধে।
‘না’ জানায় মিনাল
(অভিনয়ে তাপসী পান্নু)। সে ‘না’ জানায় তাঁর শরীরি ইচ্ছেটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য!
সে না জানায় রাজভীরের বিরূদ্ধে একটা গোটা পুরুষতন্ত্রের বিরূদ্ধে। “আমার শরীর আমার
সিদ্ধান্ত!” আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারটা থেকেই যায়, অধিকার থাকে মানুষ নির্বাচন
করার... Either you are paying for it or not paying for it! ইচ্ছে প্রতিষ্ঠা করার
দুঃসাহস-এর থেকেই ‘পিংক’-এর কাহিনীর সূত্রপাত। তবে কোনো অ্যাসিড অ্যাটাক বা
মার্ডার নয়, ‘পিঙ্ক’-এ পুরুষতন্ত্রের হাতিয়ার লিগাল স্টেপ! যেকোনোভাবে বুঝিয়ে
দেওয়া, “তুমি একজন মেয়ে, তোমার জায়গা আমার নিচেই!”, পুরুষতন্ত্রের বেসিক রুল!
পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমে ‘মেয়ে’ নামক বস্তুগুলোর জন্য একটা বেঁধে দেওয়া জায়গা
থাকে, সেই ঘেরাটোপ থেকেই যারা বেরোনোর চেষ্টা করে তাদের জন্যে বরাদ্দ থাকে
‘শাস্তি’...সাহসী হওয়ার শাস্তি...স্বাধীন জীবনযাপনের শাস্তি। যে ‘শাস্তিগুলো’
সম্পর্কে বয়সন্ধি থেকেই একটু একটু করে জানান দেওয়া হয় একটা বাড়ন্ত
শরীরকে...পাশাপাশি ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় একটি বাড়ন্ত মনেও। পুরুষতন্ত্রের কাছে প্রকারভেদটা দুরকমঃ ১) মানুষ ২) মেয়ে। পোশাকের ইঞ্চিটা ঠিক
করে দিতে দিতে ভুলেই যায় স্তনের ভেতরে একটা হৃৎপিণ্ডও আছে। তাঁর ঠিক তাঁর ভুল,
তাঁর মন্দ তাঁর ভালো সবটুকু ঠিক করে দেওয়া থাকে। পিংক-এর ঝাঁকুনিটা এই জায়গাতেই,
“কোনো মেয়ে যদি একটু হেসে কথা বলে,তাহলেই সে খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে!” একজন মেয়ের
আচার আচরণের উপরেও বসে পুরুষতান্ত্রিক নজরদারি।
২ঘন্টা ১৫
মিনিটের একটি লড়াই স্ক্রিনে দেখতে থাকি। শুধু মিনাল, ফলক , Aendra-এর লড়াই নয়, লড়াইটা আমাদের সকলের। অন্তত যা্রা নির্বাচত ঘেরাটোপ
থেকে বেরিয়ে এসে বাঁচি...যারা স্বাধীন জীবনযাপনে বিশ্বাসী...যারা বয়ফ্রেন্ডের
মুখের উপর নিজের সিদ্ধান্ত জানাই...যারা পুরুষতন্ত্রকে সময় শেষের হুমকি দিই...হুম!
যারা জেন্ডার ইকুয়ালিটির স্বপ্ন দেখি! ‘পিঙ্ক’ এমনই একটি লড়াইয়ের ছবি, একটি
প্রতিবাদী শব্দ। কতগুলো চেনা জানা সত্যিকে চোখের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া!
মানুষকে ধাক্কা দিয়ে বলা যে দেখুন, দেখুন প্রতিদিন কি হচ্ছে!
‘পিঙ্ক’ ছবির
অন্যতম প্রধান চরিত্র মিনাল(অভিনয়ে তাপসী পান্নু)
একটি বোল্ড এবং
সাহসী ক্যারেক্টার। বলা যায় একবিংশের ফেমিনিসমের একটি দৃষ্টান্ত। যে কাঠগোড়ায়
দাঁড়িয়ে ভয়হীন ভাবে চিৎকার করে অপরাধীকে বলে যে সেই ছেলেটির দুটো চোখই তাঁর নষ্ট
করে দেওয়া উচিৎ ছিল। “are you a
virgin?” প্রশ্নটির উত্তর সবার সামনে দিতে সে কোনো দ্বিধাবোধ করেনা।
ব্ল্যাকমেলিং-এর বিরূদ্ধে লিগাল স্টেপ নেওয়ার জন্য তাঁকে মলেস্টেড হতে হয়, তাও সে
ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসেনা।
Aendra (অভিনয়ে
Andrea Tariang) মেঘালয়ের মেয়ে।
আমাদের সিস্টেমের
একটি চলতি রীতি আছে;
নর্থ ইন্ডিয়ার মেয়েদের অন্যান্য আর চারপাঁচজন ভারতীয় মেয়ের থেকে
‘অন্যরকম’ দেখতে হয় বলে তাঁদের ডেইলি হেনস্থা
বেশ কিছুটা বেশি। তাঁদের শুনতে হয়, “চাইনিজ” “হট চাইনিজ” ইত্যাদি মন্তব্য এছাড়াও অনেক অনেক কিছু!
তাঁদের মধ্যেই একজন, বলা ভালো তাঁদের হয়েই একজন
Aendra। সে মেঘালয়ের ছিল তাই সমাজের
থুড়ি আইনের কাঠগোড়ায় একটা অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, তাঁর হোমটাউন কি? পরিচালক খুব সতর্কিতভাবে
চরিত্রটি নির্বাচন করেন, হয়তো তাঁর হোমটাউনটাও ইচ্ছাকৃতভাবেই
মেঘালয়। কারণ মেঘালয়তেই চলে মাতৃতন্ত্র।
ফলক (অভিনয়ে কৃতি কুলহারি) আরো একটি পরিচিত শেড।
একজন অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার মেয়ে,
যে ঝামেলা এড়িয়ে চলে। ফলক হল আমাদের ফ্রেণ্ড সার্কেলের সেই সদস্যটি যে আমাদের
কঠিন সময়ে মাথা ঠান্ডা রেখে সঠিক উপদেশ দেয়। যে তুলনামূলক ম্যাচিওর হয় বাকি বন্ধুদের থেকে! ফলকের বাড়িতে তাঁর অসুস্থ ভাই। সে দিল্লী আসে একটা চাকরির জন্য, উপার্জনের জন্য! এইক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন
স্ৎ পথে উপার্জনের জন্য। এই সবথেকে শান্ত মেয়েটাই যে সবথেকে ভয়ংকর হতে পারে সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই
হয়তো পরিচালক ফলকের মুখে সবথেকে উদ্ধত এবং সাহসী সংলাপটি বসান, “প্রস্টিটিউশন হলেও ‘না’ মানে ‘না’ ই।”
‘পিংক’-এ পুরুষত্বের বেশ কয়েকটি দৃষ্টান্তগুলি পাওয়া যায়।
১) রাজভীর ও তাঁর বন্ধুরা। এরা হল সিস্টেমের
সেই মানুষকটা যারা মেয়েদের নিজেদের সম্পত্তি মনে করে। সেই গোষ্ঠীটিকে আরো একবার মুখোশবিহীন অবস্থায় ‘পিংক’ সবার সামনে নিয়ে আসে। তাদের চরিত্রটিকে নির্দিষ্ট করার জন্য তাদের ঠোঁটে বসানো
হয় সেই বহুপ্রচলিত এবং পরিচিত সংলাপ, ওরা মেয়ে
কতদূর আর যেতে পারবে? কিংবা মেয়েটা খুব বার বেরেছে ওকে বুঝিয়ে
দেওয়া উচিৎ ওর জায়গাটা কোথায়। এই গোষ্ঠীভুক্ত মানুষেরা ‘না’ শুনতে ভালোবাসেন না,ভাবেন সম্পূর্ণ পৃথিবী তাদের পৌরুষের
পায়ে এসে মিনতি করবে। যারা নিজেদের দোষ আড়াল করার জন্য বিপরীতের সেই ‘উদ্ধত মেয়েটির’ গায়ে লাগিয়ে দেয় প্রস্টিটিউশনের তকমা,
তৈরী করে মেয়েটির ‘কোয়েশ্চনেবল ক্যারেক্টার’।
২) ফলকের বয়ফ্রেন্ড। একজন ডিভোর্সড মধ্যবয়স্ক প্রফেসর। যে ফলকের থেকে বয়সে অনেকটা বড়ো। ফলককে ফিনান্সিয়ালি হেল্প করতেন এই মানুষটি। ফলক নিরুপায় ভাবে তাঁর কাছে যায়
তাকে পাশে পাওয়ার খাতিরে। কিন্তু এই যেই সময়ে তাঁর ফলকের পাশে থাকা উচিৎ ছিল, ফলকের তাকে প্রয়োজন ছিল সবথেকে বেশি, সেই সময় তিনি নিজস্বার্থে নিজেকে
গুটিয়ে নেন। একজন স্বার্থপর মানুষ, বলাভালো একটি স্বার্থপর পুরুষত্ব।
৩)দীপক। মিনাল, ফলক, Aendra -এর
লইয়ার(lawyer)(অভিনয়ে অমিতাভ বচ্চন)।
‘পিঙ্ক’-এর আরো একটি প্রধান চরিত্র। পরিচালক অত্যন্ত যত্ন করে এই চরিত্রটিকে তৈরী করেছেন। তাঁর ঠোঁটে বসিয়েছেন তীক্ষ্ণ সংলাপগুলি। যে বিষয়গুলি সিস্টেমের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন ছিল, সেগুলিকেই সংলাপ তৈরী করেছেন রিতেশ(Ritesh Shah, dialogue writer of Pink)। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তখন, যখন বিগ বি-এর স্বরে শোনা যায় “yah par ghadi ki sui character decide karti hai!” দীপকের স্বর রুখে দাঁড়ায় অন্যায়ের বিরূদ্ধে। তাঁর সংলাপের ধারে স্টেরেওটাইপ চিন্তাভাবনারগুলর গা কেটে যেতে থাকে, ক্ষতের জায়গায় তৈরী হয় নতুন ভাবনার কোশ। ব্যপারটা হয়ে ওঠে, ‘শরীর তোমাদের স্বর আমার!’
সংলাপ তৈরিতে রিতেশ অনবদ্ধ। ‘পিঙ্ক’-এর প্লাস পয়েন্ট হল ‘পিঙ্ক’-এর সংলাপ।
শান্তনু মৈত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ছবিটিকে একটি অন্যমাত্রা দেয়। তৈরী হয় থ্রিল,
একটু একটু করে গড়ে দেয় লড়াইয়ের জমি। ছবিটিতে বিশেষ কোনো জাড়িজুড়ি নেই,সাদা মাটা
একটি গল্প বলার ধরণ। ছবিটি শুরু হয় একটি ক্রাইমের আফটার এফেক্ট থেকে। সেই না
দেখানো ক্রাইমটি ঘিরেই থ্রিল।
কাঠগোড়ায় দাঁড়ানো সাক্ষীগুলির স্টেটমেন্টকে ভিত্তি করে সেই না দেখা ক্রাইমটির
যে ছবি নিজের মনে মনে করে নেওয়া যায়, শেষ দৃশ্যে এক্সাক্ট ঘটনাটি দেখিয়ে নিজের
মনের মত সাজিয়ে নেওয়া সেই ছবির উপর একটা বাড়তি এবং অপ্রয়োজনীয়তা যোগ করা হয়েছে বলে
মনে হল।
‘পিংক’-এ পুলিশ অফিসারটিকে মহিলা করা খানিকটা ইচ্ছাকৃত মনে হল। যেখানে
ফেমিনিসমের কথা হচ্ছে, সেখানে একটা নেগেটিভিটির খুব প্রয়োজনীয়তা ছিল বলে মনে হয়না!
‘পিংক’ নামটি নিজেই অ্যাট্রাক্টিভ। পিংক বা গোলাপি রঙটি ‘গার্লস কালার বা
মেয়েলি রং’ বলেই পরিচিতি আছে। একই কারণে এই ছবির নাম ‘পিংক’, এরকম ধারণা করে থাকলে
সেই ধারণাটি কিন্তু ভুল!
(Enters writer Veeresh Malik, who wrote a blog
on TOI, to explain the meaning. In fact, he has done a lot of research and
found out that in many countries and cultures, the word Pink means “vagina of
the sort that is bought, with violence”.) অর্থাৎ যোনির
রং গোলাপি। ‘পিংক’ অধিকারের কথা বলে, ‘পিংক’ বিপ্লবের কথা বলে। ‘পিংক’---একটি
প্রতিবাদ। স্টেরেওটাইপ চিন্তাগুলির বিরূদ্ধে প্রতিবাদ, গোটা পুরুষতন্ত্রের
বিরূদ্ধে প্রতিবাদ। ‘আমার যোনি, আমার সিদ্ধান্ত, আমার অধিকার’, the fucking fact is in front of you!
Picture courtesy : Google
No comments:
Post a Comment