HAPPY READING...


Tuesday, 28 July 2020

কোভিড সংক্রমণ ও অস্পৃশ্যতা : বর্বরতার সভ্যতা


আমরা কি অমানুষ হয়ে যাচ্ছি না কি ছিলাম ?

 


কোভিড-19 এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে আমাদের । এই সময়ে কি আমরা আরও স্বার্থপর হয়ে উঠেছি না কি আমরা স্বার্থপরই ছিলাম ?  কোভিড শুধু আমাদের মুখোশের অন্তরালটিকে সর্বসম্মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে ?  আমি জানি না, ভাবতেও পারি না । অস্পৃশ্যতাহীন সমাজের স্বপ্ন দেখা যখনই শুরু করেছি, তার আগেই অস্পৃশ্যতা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে । সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা সেই সত্যিকেই আরও স্পষ্ট করেছে । আর না, আমি অন্তত এইরকম একটা সমাজ চাইনি । বনগাঁর সরকারি হাসপাতালের যে ভিডিয়োটি প্রকাশ্য এসেছে, সেই ভিডিয়োটির কথা ভাবি । কী দেখলাম ? একটা মৃত্যু, যন্ত্রণা না কি বর্বরতা ? একটা যন্ত্রণাময় ভিডিয়ো, যা মানবসভ্যতাকে, মানবতাকে, মানবিকতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে । আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছে, না আপনি মানুষ নন । হতে পারেন না । আপনিও এক স্বার্থপর যন্ত্রাংশ হয়ে উঠেছেন বা আগেই ছিলেন ।


শনিবার কোরোনার উপসর্গ নিয়ে বনগাঁ হাসপাতালে ভরতি হয়েছিলেন বনগাঁর বাসিন্দা মাধবনারায়ণ দত্ত । শরীরে কোরোনার উপসর্গ ছিল । ছিল শ্বাসকষ্ট । সেখানেই অবস্থার অবনতি হয় তাঁর । কোরোনা সন্দেহজনক হিসেবে তাঁকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ । একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও হয়েছিল, শুধু ছিল না সাহায্যের হাত । ওই হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ড থেকে বৃদ্ধকে বের করে এনেছিলেন তাঁর স্ত্রী । অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর প্রয়োজন ছিল, আশপাশের লোকজনকে ডাকছিলেন বারবার । বলছিলেন, দাদা আপনি তো মাস্ক পরে আছেন, আসুন না । একটু ধরুন না । অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিন না । না কেউ এগিয়ে আসেননি, সংক্রমণের ভয় ছিল যে... ততক্ষণে সেই হাসপাতাল চত্বরে আর যেই থাক, এককোণে দাঁড়িয়ে হেসেছিল স্বার্থপরতা আর সেখানেই মৃত্যু হয়েছিল মানুষের । না ওই বৃদ্ধের কথা লিখছি না । বৃদ্ধের শরীরের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু যে কয়েকজন মানুষ সেখানে ছিলেন তাঁদের অন্তরআত্মার মৃত্যু হয়েছিল সেখানে । বৃদ্ধ মাটিতে পড়ে যান, হয়তো প্রাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন...তাঁর স্ত্রী তাঁকে নিয়ে কাকতি মিনতি করতে থাকেন । কিন্তু এগিয়ে আসেন না কেউ । এমনকি অ্যাম্বুলেন্স চালক, যিনি না কি পিপিই কিট পরেছিলেন...তিনিও এগিয়ে আসেননি । মাধববাবুর স্ত্রী তাঁকেও অনুরোধ করেছিলেন । বলেছিলেন, আপনি তো পিপিই পরে আছেন । একটু এগিয়ে আসুন না । বৃদ্ধের প্রয়োজন ছিল অক্সিজেনের । কারণ সেইসময় তাঁর শ্বাসযন্ত্র প্রায় বিকল । আমি জানি অক্সিজেন না পাওয়ার যন্ত্রণা কেমন হয় । আমি জানি, বাতাসে অনেক অক্সিজেন রয়েছে, কিন্তু তুমি নিতে পারবে না...সেই অনুভূতি ঠিক কেমন হয় ! আমি এও জানি, কাছের মানুষকে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতড়াতে দেখলে কী অনুভব হয় !

যাকগে, বৃদ্ধের বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা, তাঁর স্ত্রীর কাকতি মিনতি...এইরকম কতক্ষণ ঠিক চলেছিল?  আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে একটা মানুষ একটু জীবনের জন্য কাতড়াচ্ছিলেন আর আমরা এই যাদের অনেকটা মানুষের মতোই দেখতে তারা পাশ কাটিয়েছিলাম, সংক্রমণের ভয়ে! অ্যাম্বুলেন্সে টেনে হিঁচড়ে ওঠানোর চেষ্টা করেছিলেন মাধববাবুর স্ত্রীই । কিন্তু শেষরক্ষা হযনি, ওইখানে পড়ে যান বৃদ্ধ । মারা যান । তখনও তাঁর স্ত্রী বলে যাচ্ছেন, দাদা ট্রে টা একটু নামান না !  আশপাশের ব্যক্তিরা বলেছিলেন, "কাকা উঠে পড়ুন, উঠতে পারলেই বেঁচে যাবেন!" না আর বাঁচা হয়নি তাঁর । উঠতে পারেননি তিনি ।


আসলে আমরাই বুঝিনি । সংক্রমণ ছড়িয়ে গিয়েছে । যে ভয় আমাদের স্বার্থপরতার শিকলে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, সেই ভয় কী তা বুঝে ওঠার আগেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে । বর্বরতার সংক্রমণ, অমানবিকতার সংক্রমণ । আর আমরা সবাই সংক্রমিত ।

এই সমাজের কোশে কোশে শ্রেণিবিভাজন রয়েছে, বৈষম্য রয়েছে । না আমি এখানে মার্কসবাদী কোনও তত্ত্ব নিয়ে বড় বড় কথা লিখছি না । আমি লিখছি, সপাট সত্যির কথা । প্রতিবছর যক্ষ্মায় কত মানুষ মারা যান তার হিসেব আমরা রাখিনি, কারণ যক্ষ্মা অধিকংশক্ষেত্রেই সেই নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । আমরা ভেবে দেখিনি । কারও রক্ত উঠছে শুনলে নাক সিঁটকেছি । জরাজীর্ণ কঙ্কালসার চেহারা দেখে আঁতকে উঠেছি, তাও আমাদের খারাপ লাগেনি । কিন্তু কোভিড কাউকে ছাড়েনি । জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ নির্বিশেষে হু হু করে ছড়িয়ে পড়েছে । বহুতল আবাসনের প্রত্যেকে আক্রান্ত হয়েছেন, প্রিভিলেজড শ্রেণিটির সাজানো সুন্দর অন্দরে অসুখ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে । আর তাই আমাদের টনক নড়েছে । আমাদের মধ্যে লুকিয়ে রাখা বিবর নিজেকে গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তখন । এই যে অস্পৃশ্যতায় মেতেছে মানুষ, সামাজিক দূরত্ব-র নামে অমানবিকতার খোড়াক পুষেছে, এই অস্পৃশ্যতা নতুন নয় । এর শিকড় অনেক গভীর, শুধু ভিন্ন নামে প্রকাশ্যে এসেছে । ভারত সেই দেশটাই, যেখানে কলার টিউনে বারবার মনে করিয়ে দিতে হয়, রোগের সঙ্গে লড়ুন, রোগীর সঙ্গে নয় । ওঁদের সঙ্গে ভেদাভেদ করবেন না । হ্যাঁ ঠিক, এটাই আমার দেশ । এটাই আমরা । একটা বর্বর, কুৎসিত মুখ । আমাদের সামনে মানুষের মৃত্যু দেখলেও আমরা এগিয়ে যাব না, সাহায্যের একটা হাত বাড়িয়ে দেব না । কারণ আমাদের মৃত্যু ভয় আছে, সংক্রমণ ভয় আছে । আসলে আমাদের একটাই অসুখ আছে, স্বার্থপরতা! এর বাইরে আমরা বের হতে পারিনি । তাই মানুষের কান্নায় পাশে দাঁড়াতে পারিনি, মৃত্যুতে বন্ধু হতে পারিনি । বাঁচার আশা জোগাতে পারিনি । কারণ আমরা বাঁচতে চেয়েছিলাম । এই সমাজ বিশ্বাসঘাতক, আমরা প্রত্যেকেই এক একজন বিশ্বাসঘাতক । যাঁরা যুগের পর যুগ বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছি, নীতাদের সঙ্গে । আমরা তাঁদের বাঁচতে দিইনি, কারণ আমরা নিজেরা বাঁচতে চেয়েছিলাম । মেঘে ঢাকা তারার শেষ দৃশ্য আমাদের বিশ্বাসঘাতক চেহারাটিকে প্রকাশ্যে এনেছিল । আসলে আমরা জানি না, স্বার্থপরতা, শ্রেণিবিভেদ, লিঙ্গবৈষম্য, বর্বরতা, অস্পৃশ্যতা আমাদের শরীরে ছড়িয়েছে । প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে, যাঁরা ঘুরছি তাঁরা লাশ । এক একটি নরখাদক লাশ ... আমরা প্রত্যেকেই এই পাপের ভাগীদার!

No comments:

Post a Comment