HAPPY READING...


Friday, 12 July 2019

পিতৃতান্ত্রিক এবং শ্রেনী শোষণের একটি রাষ্ট্রকাহিনী: আর্টিকেল ১৫

সমাজে বা অন্যান্য যে কোনো গঠন ব্যবস্থায় দু'টি শ্রেণীই হয় এক শাসক শ্রেণী বা শোষক শ্রেনী, দুই হল যারা শাসিত ও শোষিত হয়। একটি সম্পর্ক, একটি পরিবার ব্যবস্থা তথাপি একটি সমাজ ব্যবস্থায় এই দুই শ্রেনীই বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হয়। আপাতত যে বিষয়টি আলোচ্য, তা হল এই প্রত্যেক শ্রেণীশোষণ। হিন্দু সমাজের পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ সমাজের কদর্য্য ইতিহাসের রূপ সবার জানা। সবার জানা, জাতিবিভেদ ও বর্ণ বিভেদ সৃষ্টির কথা।
আমাদের এও জানা, স্বল্প বয়সী বিধবা মেয়েদের ব্রাহ্মণ সমাজের তার ভোগ বস্তুতে রূপান্তরিত করার কথা। দিনের আলোর প্রকাশ্যে যে মহিলাকে সমাজের এক ঘরে করে দেওয়া হয়, রাতের অন্ধকার তার ঘরে পুরুষাঙ্গের জবরদস্তি প্রবেশ ঘটিয়ে তাঁকে তাঁর শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। আমরা শ্রেনীশোষণ, জমিদার বা সামন্ততান্ত্রিক প্রথার কথা পড়েছি। কর আদায়ের প্রেক্ষিতে বেতাঘাত, অত্যাচারের কথা পড়েছি। এবং এই বিষয় স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত যে, একদল জবরদস্তি শাসন করে আর একদল শোষিত হয়। আমরা ভাবি এই জাতিভেদ প্রথা এই অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটেছে, কিন্তু কই? আমার পারিপার্শ্বিক গণ্ডিটাই একটা ভারতবর্ষ নয় যে! উত্তরপ্রদেশের এক হিন্দুত্ববাদী প্রত্যন্ত গ্রামও সেই ভারতবর্ষের অংশ, যেখানে শ্রেণী শোষণ একইভাবে আজও প্রাসঙ্গিক। মার্ক্সবাদ শ্রেনীশোষণকেই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি বলে চিহ্নিত করে, মার্ক্সবাদী ফেমিনিস্টরা লিঙ্গভিত্তিক শোষণের চেয়ে শ্রেণী শোষণকেই বেশি গুরুত্ব দেন, মার্ক্সবাদকে সমালোচনা  করে হার্টম্যান তাঁর 'The Unhappy Marriage of  Marxism and Feminism' প্রবন্ধে   উল্লেখ করেন পুঁজিবাদের চেয়েও পিতৃতান্ত্রিক শোষণ অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক কারণ কালের দিক থেকে তা অনেক বেশি পুরাতন।  পরবর্তীকালে নিউ লেফট, ইয়াং মার্ক্স, সম্পর্কিত মার্ক্সীয় আলোচনা, গ্রামসির চিন্তার নবমূল্যায়ন, ইত্যাদি মতাদর্শ ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে স্বতন্ত্রভাবে গুরুত্ব দেয়। শ্রেনীশোষণের বাইরেও পিতৃতান্ত্রিকতার একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে তা হার্টম্যানের মন্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উৎপাদনক্ষম শ্রম, উৎপাদন প্রক্রিয়ার বাইরেও পরিবার ও প্রজননক্ষেত্রেও পিতৃতান্ত্রিক মূল থাকতে পারে। অঅর্থাৎ, শ্রেণী শোষণের উর্দ্ধেও পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গভিত্তিক শোষণের অবশ্যই একটি অস্তিত্ব রয়েছে। আলোচ্য এই যে, একটি গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় জাতিভেদে, বর্ণভেদে যে শ্রমবিভাজন ও শ্রেণীবিভাজনের প্রেক্ষিতে যে শ্রেণীশোষণ প্রচলিত সেই শোষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘৃণ্য জায়গায় থাকছে 'লিঙ্গভিত্তিক পিতৃতান্ত্রিক শোষণ'! পৌরুষ ও নারীত্ব কী? আর্টিকেল ১৫ নিয়ে আলোচনা করার আগে সদ্য আলোচিত আর একটি ছবি 'কবীর সিংহ' নিয়ে দুই একটি লাইন লিখব। নারীবাদী প্রাস্কপেক্টিভ থেকে দেখার পর ছবিটি তীব্র সমালোচিত হয় এবং তাকে মিসোজিনিস্ট ছবি বলা হয়। শুধুমাত্র কবীর সিংহ কেন বলিউডের বেশিরভাগ মূলধারার ছবিরই দৃশ্যপরিকাঠামো অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক ও একটি পুরুষ দৃষ্টিকে সুখপ্রদান করতে তৈরি হয়, যেখানে দেখার বিষয়ী সব সময়েই নারী ও দৃষ্টিবাহক পুরুষ। এই নিয়ে ফেমিনিস্ট ফিল্ম থিয়োরিতে একাধিক প্রবন্ধের উল্লেখ করা যায়। এতদূর না ভেবেও, কবীর সিংহ-এর সমালোচনায় অনেককে রুখে দাঁড়িয়ে ফেমিনিস্টরা বাড়াবাড়ি করছে যাবতীয় কথা বলতে শোনা যাচ্ছে, 'রানঝনা'-এর সময়ে এইসব ফেমিনিস্টরা কোথায় ছিল জাতীয় কথা উঠে আসছে। একটি মেয়ে(সে প্রেমিকা বা বিলাভেড) যখন ছেলেটিকে (প্রেমিক)-কে চড় মারছে সেটি অন্যায় নয় আর ছেলেটি করলেই অন্যায়, এ ফেমিনিস্টদের কেমন বিচার? উল্লেখ করি, সম্পর্কে ফিসিকাল ও মেন্টাল অ্যাবিউস কোনোটাই গ্রহণযোগ্য ও ক্ষমা যোগ্য নয়, সে যে পক্ষই করুক। এখন এই বিষয়টি আরো একবার মনে করা দরকার, একজন পুরুষ তার স্ত্রী বা প্রেমিকাকে থাপ্পড় মারেন বা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করেন শুধুমাত্র তার মেল সুপ্রিমেসি দেখানোর জন্য, স্ত্রীকে দমিয়ে রাখার জন্য যা একটি শোষণ, লিঙ্গভিত্তিক শোষণ। একইভাবে, যদি তা অপরপক্ষও করে।  এই দুই উদাহরণের কোনো তুলনা চলেনা। ফিল্মের ক্ষেত্রে যেখানে গোটা দৃশ্য পরিকাঠামোই যখন পিতৃতান্ত্রিক সেক্ষেত্রে একটি দুটি দৃশ্য এক্সেপশন হয় উদাহরণ হয়না। 'Women's Cinema as Counter Cinema'- এ ক্লেয়ার জন্সটন উল্লেখ করছেন চলচ্চিত্র একটি সেক্সিস্ট ইডিওলজিকে মেনে চলে তাই তার বিরোধিতা করতে গেলে সেই সিস্টেমের মধ্যে থেকেই সিস্টেমের বিরূদ্ধে ছবি বানাতে হবে। যেমন, শ্রেণিশোষণে মুক্তির পথ সংগ্রাম ও অস্ত্র বলে ভাবা হয়।

শ্রেণীশোষণ ও লিঙ্গভিত্তিক শোষণ নিয়ে আলোচনা করার কারণ, 'আর্টিকেল ১৫' ছবিটি নিয়ে আলোচনা করব তাই। ছবিটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে এবং ছবিটির সত্য ঘটনাটি অর্থাৎ ছবির গল্প সবার জানা, তাও একবার আলোচনা করে নিই। উত্তরপ্রদেশের একটি গ্রামে দুজন বোন দিন প্রতি ২৫টাকার বিনিময়ে শ্রমিকের কাজ করত, তারা জাতিতে নিম্নবর্ণীয় ছিল। উত্তরপ্রদেশের সেই গ্রামে উচ্চবর্ণীয়রা নিম্ন বর্ণীয়কে ক্রীতদাস হিসেবে দেখে এবং তাদের ছোঁয়াও খায়না। তারা দিন প্রতি ৩টাকা মজুরি বানানোর দাবিতে তাদের মালিক তাদের মারধোর করে এবং মেয়ে তিনটি ও অন্যান্য কিছুজন সেই কাজ ছেড়ে কাছেই একটি জুট মিলে কাজ শুরু করে। এরপর মেয়ে তিনজন(একজন মারা যায়নি) নিঁখোজ হওয়ার পরেও তাদের বাড়ির অভিযোগ লোকাল থানা নথিভুক্ত করেনি, তার দুদিন পর তাদের দুজনের মৃতদেহ গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।



 প্রাথমিক ময়নাতদন্ত প্রমাণ করে যে এটি গ্যাং রেপ ও মার্ডার কিন্তু সিবিআই সেসব ভুল প্রমাণ করে আবার অক্টোবর মাস ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট সেটিকে মিথ্যে হিসেবে খারিজ করে ও অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়। এই আলোচ্য ঘটনাটি ২০১৪ সালে ঘটে।
এই প্রেক্ষাপটেই 'আর্টিকেল ১৫' এর স্টোরিলাইন। আয়ন রঞ্জন আইপিএস অফিসার ইনচার্জ হয়ে থানায় আসার পর পরই এই ঘটনাটি ঘটে। সম্পূর্ণ  ছবিতে একটি কালার টোন ব্যবহৃত হয়েছে, শীতের সকালে যখন গ্রামবাসীরা দুইজন মেয়ের মৃতদেহ খুঁজে পায় সেই দৃশ্যটিতে ব্যবহৃত কালার টোন নীলচে অর্থাৎ 'ওয়ার্মথ' নয়।





 একটি শীতের ভোরবেলা সম্পূর্ণ দৃশ্যজুড়ে শীতলতা নিয়ে আসে, একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রনা অনুভব হয়। সংলাপের দ্বারা অভিব্যক্তি প্রকাশ না করেও শুধুমাত্র আলোর ব্যবহার ও কালার টোন এবং ছবির ডিটেইলিং সেই দৃশ্যের সেই মুহূর্তের যন্ত্রণার তীক্ষ্ণতা অনুভব করায়।



 একাধিক দৃশ্য বারবার মনে করিয়ে দেয় ২০১৯ এর প্রেক্ষাপটের ভারতবর্ষ বর্ণবিভেদে এক শ্রেণীশোষণ জারি রাখে।  একই মন্দিরে ভাত খাওয়ার জন্য নিম্নবর্ণীয়দের বেত্রাঘাত করা হয়। সাম্প্রতিক হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছবিটির জাতিগত বর্ণগত রাজনীতি, পিতৃতান্ত্রিক জেন্ডার  রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ছবিটিতে দৃশ্যায়িত একটি মন্তাজে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক নেতার সভা, ভারতের জয়জয়কার একইসাথে নিম্নবর্ণীয়দের অত্যাচারিত হওয়ার দৃশ্য তার সভায় আগুন লেগে যাওয়ার দৃশ্য একইসাথে ক্রসকাটিং- দেখানো হয়।



 এইরূপ দৃশ্যগঠন প্রশংসনীয় একইসাথে অস্বস্তিকরও। সর্বশেষে আলোচনা করি, বলিউডের মেন্সট্রিম ছবি যখন কেবলমাত্র একটি পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টি পরিকাঠামোকে তোষামোদ করে, পুরুষ দৃষ্টি ও পুরুষ যৌনতাকে সুখপ্রদান করতে চায় সেই একই সময়ে দাঁড়িয়ে বলিউড মেন্সট্রিম রাষ্ট্রের সংবিধানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক ফান্ডামেন্টাল রাইটকে গুরুত্ব দেয়।  জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সেক্স, জন্মস্থান নির্বিশেষে রাষ্ট্র কারোর প্রতি কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করবেনা, এবং প্রত্যেকের অধিকার সমান। অর্থাৎ সাম্যতা এবং রাইট টু ইকুয়ালিটির একটি। আইপিএস    আয়ন রঞ্জন আর্টিকেল ১৫ এর একটি প্রিন্টেড কপি যখন থানার নোটিশ বোর্ডে এনে লাগায় এবং আবহে 'বন্দেমাতারম' গানটি শোনা যায়, চোখে জল আসে গায়ে কাঁটা দেয়! এই মাতৃভূমির কথাই তো ভেবেছি এই মাতৃভূমিকে বন্দনা করেছি আমরা। আয়ন রঞ্জন তার প্রেমিকার সাথে ফোনের কথোপকথনের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে, তথাকথিত নায়ক নায়িকার সম্পর্কের সংজ্ঞা পেরিয়ে আর্টিকেল ১৫ -এ একটি সাম্যতার  সম্পর্ক তৈরি হয়। আয়নের গার্লফ্রেন্ড অদিতিকে যে পেশায় একজন লেখিকা ( জেন্ডার পলিটিক্স, উওমেন রাইটস নিয়ে লেখালেখি করে) ফোনে যখন আয়ন  বলে, তোমার একজন হিরো চাই, উত্তরে অদিতি জানায়, আমার হিরো নয় এমন মানুষদের চাই যাদের একজন হিরোর প্রয়োজন নেই।

   এছাড়াও ছবিটি নিম্নবর্ণীয়দের অধিকারের জন্য লড়াই করা অ্যাক্টিভিস্টদের উপরেও দৃষ্টিপাত করে।
আর্টিকেল ১৫ মনে করিয়ে দেয়, একটি ঘৃণ্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কথা। যেখানে শ্রেণী শোষণের উর্দ্ধে   পিতৃতান্ত্রিক শোষণ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। নিম্নবর্ণীয় হওয়ার ভিত্তিতে মালিক শ্রেণি শ্রমিক শ্রেণির মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিক শ্রেণিকে অত্যাচার করতে পারে, কিন্তু তা যদি দুটি মেয়ে হয় তবে তার উপর অত্যাচারের মাপকাঠিটা দ্বিগুণ হয়। ধর্ষণের  মত পিতৃতান্ত্রিক হাতিয়ারকে ব্যবহার করে তাদের গোটা গ্রামের সামনে গাছ থেকে জীবন্ত ঝুলিয়ে দেওয়া যায় শুধুমাত্র তাদের 'অওকাত' বোঝানোর জন্য। যাতে তারা একটা উদাহরণ হয়ে থাকে গোটা সমাজের কাছে, যারা অন্তত নিজেদের অধিকারের জন্য সামান্য কথা বলেছিল। নিজের ফান্ডামেন্টাল রাইটের প্রেক্ষিতে ভিত্তিতে বলেছিল।


কন্টেম্পরারি পলিটিকাল অ্যাজেন্ডা, শ্রেণী শোষণ ও পিতৃতান্ত্রিক শোষণ রাষ্ট্রের প্রতিটা কোষে কোষে রয়েছে আদিমযুগ থেকে। জাতি ধর্ম বিশেষে তা অন্য রূপ ধারণ করেছে কেবল।                                                                          

No comments:

Post a Comment