HAPPY READING...


Wednesday, 7 March 2018

পুরুষতন্ত্রের 'ভালো গার্লফ্রেন্ড'


আমি যখন প্রথমবার রবি ঠাকুরের স্ত্রীর পত্রপড়ি তখন আমার বয়স খানিক অল্প ছিল, কলেজের প্রথম বর্ষ। শহরতলির গন্ডি পার করে তখন সবে সবে শহরের কলেজে পড়তে এসেছি, শহুরে হাবভাব গায়ে মাখতে শুরু করেছি সবে। তখন আমার চারপাশটা নিয়ে অর্থাৎ ছোট থেকে যেইটিকে ‘সমাজ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে সেটা নিয়ে ধারণা তৈরি হয়নি তেমন। আমি তখন জটিল তত্ত্ব হিসেব এসব বুঝতাম না, আমি নারীবাদ বুঝতাম না…নারীদিবস নিয়েও কোনো ধারণা ছিল না আমার। স্কুলে পড়ার সময়ে কেবল বন্ধুদের মুখে শুনেছিলাম, ‘অমুক’ ভীষণ ভালো গার্ল ফ্রেন্ড কারণ ও ওর বয়ফ্রেন্ড তমুকের সব কথা শোনে। মেয়েটির পোশাক আশাক থেকে শুরু করে চালচলন সবই ওর সমবয়সী নাক টিপলে দুধ বেরোনো ছেলেটি ঠিক করে দিত। আমার তখনও ভালো গার্ল ফ্রেন্ড হওয়ার ইচ্ছে ছিলনা, তাই আমার সেসময়কার বইয়ফ্রেন্ডটিও দু’বছর পর আর থাকতে চায়নি। এখন বুঝি অবিশ্বাসটা একটা অজুহাত ছিল ওর মধ্যযুগীয় পরিবার আমায় মেনে নিতে পারেনি। আর সেই যাঁতাকলে পরে ওরও কোনো এক সময় মনে হয়েছিল ‘ভালো গার্লফ্রেন্ডরা’ সব কথা শুনে চলে। এই সব কথা শুনে চলাটা একটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেওয়া মাত্র, নিজ বুদ্ধি দিয়ে বিচার না করে অপরের কথা বেদবাক্যের মত পালন করার কোনো অর্থই হয় কি?
 ট্রেনে করে কলেজ আসতে সেদিন যখন স্ত্রীর পত্র-এর লাইন গুলো মনের ভিতর গাঁথছিলাম তখন বুঝিনি চার বছর পরেও সেই শব্দগুলো একইভাবে মনে থেকে যাবে। স্ত্রীর পত্রে, বাড়ির মেজ বোউ চিঠিতে লিখছেনঃ “আমার যে রূপ আছে সে কথা ভুলতে তোমার বেশিদিন লাগে নি। কিন্তু, আমার যে বুদ্ধি আছে সেটা তোমাদের পদে পদে স্মরণ করতে হয়েছে। ঐ বুদ্ধিটা আমার এতই স্বাভাবিক যে তোমাদের ঘরকন্নার মধ্যে এতকাল কাটিয়েও আজও সে টিকে আছে। মা আমার এই বুদ্ধিটার জন্যে বিষম উদ্‌বিগ্ন ছিলেন, মেয়েমানুষের পক্ষে এ এক বালাই । যাকে বাধা মেনে চলতে হবে, সে যদি বুদ্ধিকে মেনে চলতে চায় তবে ঠোকর খেয়ে খেয়ে তার কপাল ভাঙবেই। কিন্তু, কী করব বলো। তোমাদের ঘরের বউয়ের যতটা বুদ্ধির দরকার বিধাতা অসতর্ক হয়ে আমাকে তার চেয়ে অনেকটা বেশি দিয়ে ফেলেছেন, সে আমি এখন ফিরিয়ে দিই কাকে। তোমরা আমাকে মেয়ে-জ্যাঠা বলে দুবেলা গাল দিয়েছে। কটু কথাই হচ্ছে অক্ষমের সান্ত্বনা; অতএব সে আমি ক্ষমা করলুম।” মেয়েমানুষের বেশি বুদ্ধি থাকা যে একেবারেই উচিত নয় সেই ধারণাটি আজ বছরের পর বছর ধরে হাঁটাচলা করে এসে একবিংশ-এর তথাকথিত লিবারেল মানুষগুলোর চিন্তাতেও একইভাবে বিরাজ করে। আর আমি শুধু ভাবি কি করে ভালো গার্লফ্রেন্ড হওয়া যায়! তার একটা ছোটখাটো লিস্টি বসে তৈরি করি। আমি এখানেই সতর্ক করছি লেখাটির মাধ্যমে আমি কোনো শ্রেনীকেই জেনারালাইস করছিনা, তাই হামলে পরার কিছু নেই। যাই হোক লিস্টিতে ফিরি, ভালো গার্লফ্রেন্ড হওয়ার জন্য সবার প্রথম যেটা দরকার তা হল একটা সুন্দর ফিগার। সুন্দর দুটো স্তন(আমার মনে হয় স্তন কথাটার সাথে অনেকেই পরিচিত নয় বেশিরভাগই ‘বুবস’ , ‘মাই’ এসব কথাগুলোর সাথে পরিচিত। তাই স্তন শব্দ দেখে ঘাবড়াবার কিছু নেই), আকারে বেশি বড়ও হবেনা আবার খুব ছোট হলেও সমস্যা…টাইট সুন্দর বুক হতে হবে আরে মোটামুটি যেটায় হাত বুলিয়ে প্রেমিকটির যৌনতা বড়ই আরাম পায়। সুন্দর কোমর, পাছা, থাই মোটের উপর যে ধরণের শরীর প্রেমিকটিকে বিছানায় আরাম দিতে পারে তাহলেই হবে। 
দ্বিতীয়ত, প্রেমিক যদি পড়াশোনায় ভালো হয়, বিখ্যাত য়ুনিভার্সিটির ছাত্র হয় আর মেয়েটি কোনো মফস্বলীয় কলেজে পড়ে তবে প্রেমিকটি বারবারই তাকে তার স্ট্যান্ডার্ড মনে করিয়ে দেবে …যেমন বন্ধুমহলে পরিচয় দেবেনা বারবার পড়াশোনার খোঁটা দিয়ে অপমান করবে মেয়েটিকে অবশ্যই সেটা চুপচাপ মেনে নিতে হবে। ঠিকই তো…বামন হয়ে চাঁদে যেমন হাত বাড়ানো…চাঁদ বামনের দিকে হাত বাড়ালেও ঘটণার কোনো পরিবর্তহবেনা। তবে যদি মেয়েটি তার প্রেমিকের সমকক্ষ কিংবা তার চাইতে একটু ভালোই হয় তাহলেও প্রেমিকটি তাকে উঠতে বসতে কথা শোনাবে…তার জীবনযাপন নিয়ে খোঁটা দেবে তার ক্রিয়েটিভিটিকে একদম সম্মান করবেনা। আর এটা একজন ভালো গার্লফ্রেন্ড হতে গেলে অবশ্যই মেনে নিতে হবে।
 তৃতীয়ত, মেয়েটির যদি কোনো জীবন দর্শন থাকে ছেলেটি বারবার সেই দর্শনে আঘাত হানতে পারে , মেয়েটি অবশ্যই চুপ করে থাকবে। মেয়েটিকে ছেলেটির বন্ধুস্থানীয় মানুষজন অপমান করে যেতে পারে , ছেলেটি এতে তার বন্ধুর কোনো দোষ দেখতে পাবেনা দোষ দেবে মেয়েটিরই…কারণ দোষটা মেয়েটিরই…তার মদ খেয়ে নেওয়াটাই উচিত হয়নি তাও আবার মেয়েয়ে।
 চতুর্থত, মেয়েটির কোনো ইচ্ছে প্রকাশ করা চলবেনা …জোর দিয়ে বলা চলবেনা তোমায় আমার এই ইচ্ছেটি রাখতেই হবে। তাহলেই প্রেমিকটি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে পারে, নয় মেয়েটিকে সেই গালিগালাজ মেনে নিতে হবে আর নয়তো কোন ইচ্ছে রাখাই চলবেনা তাছাড়া মেয়েমানুষের আবার অত ইচ্ছে কি? যেমন, জন্মদিনে একসাথে থাকার ইচ্ছে, তিন বছরে কোণ একবার রঙটা একসাথে খেলার ইচ্ছে যাবতীয়। এমনকি এক মাত্র ছেলেটি যখন কথা বলতে চাইবে তখনই সম্পর্কে কথা হবে নয়তো হবেনা। মেয়েটি যখন চাইবে তখন কথা নাও হতে পারে এবং এটাই সম্পর্কের নিয়ম।
 পঞ্চমত, প্রেমিকের পরিচিত কোনো মেয়ে হঠাতই তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন রতে পারে, প্রেমিকটিও সেই অচেনা মেয়েটিকে লিখে পাঠাতে পারে অধিকার বোধ –এর কথা। কিন্তু এই ঘটনা খুবই সাধারণ ও সামান্য তাই  নিয়ে ‘ভালো গার্লফ্রেন্ড’ একদম রিঅ্যাক্ট করেনা। অথচ, সে যদি কোনো বন্ধুর সাথে সময় কাটায় মজা করে রঙ খেলে তখন প্রেমিকটি ‘ভালো গার্লফ্রেন্ড’-এর গালে থাপ্পর মারার কথা বলতে পারে এবং এটাই ঠিক। মেয়েমানুষের অত ধিঙ্গিপনা কিসে? 
ষষ্ঠত, সেক্সে প্রেমিকের অর্গাসম ঘটানোটাই প্রেমিকার একমাত্র লক্ষ্য নিজের সেক্সুয়াল স্যাটিস্ফেকশন পাওয়াটা নয়!
সবথেকে ভালো হয় যদি প্রেমিকের সব কথা মেনে নিয়ে তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে তার জন্য গোটা জীবনটা উতসর্গ করে দেওয়া যায়। যুগ যুগ ধরে আমাদের ত্যাগের গল্প শোনানো হয়…স্বামীর জন্য ত্যাগ, পরিবারের জন্য ত্যাগ আর একবিংশে প্রেমিকের জন্য ত্যাগের ট্যাগ শিখতে হয়। আর এটার নামকরণ করা হয়, ‘ভালোবাসা’। যারা ভালোবাসার জন্য জীবন উতসর্গ করে তাদের দেবী রূপে পুজো করা হয়, কখনো সীতাকে স্মরণ করা হয় কিংবা কখনো পদ্মাবতীর জহরব্রতকে …সতীদাহকে উদযাপন করা হয়। সতীদাহের আগুন এতটাই সুদূরপ্রসারী যে সেই আগুনের গরম আঁচ এখনো আমাদের শরীরে এসে লাগে আমরা জ্বলে উঠি কিন্তু গর্জে উঠিনা! চেষ্টা করে যাই ভালো গার্লফ্রেন্ড হওয়ার, ভাবি এরপরদিন থেকে হয়তো সব ঠিক থাকবে । এই সময়ই, স্ত্রীর পত্র-এর শেষের দিকের ক’টা লাইন মনে পরে যায়ঃ “ওরে মেজোবউ, ভয় নেই তোর! তোর মেজবউয়ের খোলস ছিন্ন হতে এক নিমেষও লাগে না।
তোমাদের গলিকে আর আমি ভয় করি নে। আমার সন্মুখে আজ নীল সমুদ্র, আমার মাথার উপরে আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ। তোমাদের অভ্যাসের অন্ধকারে আমাকে ঢেকে রেখে দিয়েছিলে। ক্ষণকালের জন্য বিন্দু এসে সেই আবরণের ছিদ্র দিয়ে আমাকে দেখে নিয়েছিল। সেই মেয়েটাই তার আপনার মৃত্যু দিয়ে আমার আবরণখানা আগাগোড়া ছিন্ন করে দিয়ে গেল। আজ বাইরে এসে দেখি, আমার গৌরব রাখবার আর জায়গা নেই। আমার এই আনাদৃত রূপ যাঁর চোখে ভালো লেগেছে সেই সুন্দর সমস্ত আকাশ দিয়ে আমাকে চেয়ে দেখছেন। এইবার মরেছে মেজোবউ।
তুমি ভাবছ আমি মরতে যাচ্ছিভয় নেই, অমন পুরোনো ঠাট্টা তোমাদের সঙ্গে আমি করব না। মীরাবাঈও তো আমারই মতো মেয়েমানুষ ছিলতার শিকলও তো কম ভারী ছিল না, তাকে তো বাঁচবার জন্যে মরতে হয় নি। মীরাবাঈ তার গানে বলেছিল, ‘ছাড়ুক বাপ, ছাড়ুক মা, ছাড়ুক যে যেখানে আছে, মীরা কিন্তু লেগেই রইল, প্রভুতাতে তার যা হবার তা হোক।
এই লেগে থাকাই তো বেঁচে থাকা।
আমিও বাঁচব। আমি বাঁচলুম।

তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন – মৃণাল”

এই কথাই সত্য, সমস্ত ‘ভালো গার্লফ্রেন্ড’-দের উদ্দেশ্যে... আমার প্রেমিক আমায় ছেড়ে চলে গেছে বলার ভেতর যে সহানুভূতিটা আমাদের আত্মাকে শান্তি দেয় তার চেয়ে অনেক বেশি শান্তি দেয় দম্ভ...যে দম্ভ ভালো গার্লফ্রেন্ড না হওয়ায় আছে, যে দম্ভ অকপটে বলে দেওয়ায় আছে আমি মানিয়ে নেওয়ায় বিশ্বাস করিনা কিংবা যে দম্ভ এই কথাগুলোয় উচ্চারণ করায় আছে, “আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে ছেড়ে এসেছি, বেশ করেছি!”


বিঃ দ্রঃ – আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা জানিনা যেহেতু সেরকম কোনো কন্সেপ্টে আমি বিশ্বাস করিনা... কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সমইয় এক মানুষ আসে আমার জীবনে যে আমাকে ভালো গার্লফ্রেন্ড না হতে শেখায়, জীবনটাকে অন্যভাবে দেখতে শেখায়। সে সেইসব প্রেমিকদের বি্রূদ্ধে যারা তাদের গার্লফ্রেন্ডকে ‘ভালো গার্লফ্রেন্ড’ বানিয়ে রাখে।

No comments:

Post a Comment