আমি ‘বিসর্জন’- এর কোনো ফর্মাল রিভিউ লিখবনা, কারণ ভালো লাগার
কোনো ক্রিটিসিজম হয়না। কাল কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়-এর ‘বিসর্জন’ ছবিটি দেখে যখন মেট্রয় ফিরছিলাম
আমার এক বন্ধুর সাথে হোয়াটস অ্যাপে কথা হচ্ছিল, আমি বললাম ‘বিসর্জন’ দেখে ফিরছিরে,
আমার বন্ধু বলল, ‘কিসের বিসর্জন?’
পদ্মা (জয়া আহসান) |
গনেশ মন্ডল (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়) |
পদ্মার স্বামী মারা যাওয়ার পর যে যন্ত্রনা যে একাকিত্ব সে তার ভেতর জমিয়ে রেখেছিল, গনেশ মন্ডলের ইশারা এরিয়ে প্রতিটা দিন তাঁকে লড়াই করে যেতে হত বেঁচে থাকার জন্য লড়াই, ভালো থাকার জন্য লড়াই...নাসের সেই যন্ত্রনার মলম হয়ে তার জীবনে আসে, আসে একাকিত্বের বন্ধু হয়ে। সে পারত গনেশের থেকে এই চেনা জায়গাটা থেকে অনেক দূরে গিয়ে নাসিরের সাথে নতুন করে সংসার পাততে, কিন্তু পদ্মার সে গুড়েও বালি। এইটাই বিসর্জনের মূল কথা। পদ্মা তার মৃত স্বামীর পোশাক নাসেরকে পরতে দেয়, সিগারেট মদের গন্ধ মন ভরে নেয় আর তার স্বামীর স্মৃতিচারণ করে। এই গন্ধই পদ্মার খুব চেনা, যা সে অনেকদিন পায়নি। পদ্মা নিঃশব্দে তার একটার পর একটা বিসর্জনকে তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করে কিন্তু সে কথা কাউকে জানায় না। শেষ রাতে পদ্মা নাসেরকে বলে, পদ্মায় যে চর পরে গেছে গো! তুমিও কি থাকতে আমার সাথে? আর একটা ঘন্টা তারপর তুমিও চলে যাবে আর পেছনে ঘুরে তাকিও না কারণ বিসর্জনের পর পিছনে ঘুরে তাকাতে নেই। সুন্দর যে দুর্গা প্রতিমা তুমি বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছ, জলে তার সাজ উঠে মাটি গলে এরপর হাড্ডি গুড্ডি বেরিয়ে যাবে, ও ভয়াণক দৃশ্য দেখতে নেই... নাসের আলি পরের সূর্যোদয়ে ইছামতির এপার থেকে ওপারে চলে যায়...পদ্মাকে রেখে কিংবা বিসর্জন দিয়ে! নাসের চলে যাওয়ার পর পদ্মাকে নিয়ে গণেশ মণ্ডল ফেরে, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে বিসর্জনের বাজনা। নাসেরের নতুন জীবন দেওয়া চারদিনের মানুষটি নাসেরের প্রতিমা ছিল, যাকে নাসের বিসর্জন দিয়ে দেশে ফিরে যায়। আর পদ্মা বিসর্জন দেয় তার সারাজীবনের ভালো থাকা, তার ভালোবাসা ও তার সমস্ত স্বপ্নকে...নাসেরের জন্য। কারণ পদ্মাদেরই বিসর্জন হয়...ভালোবাসার জন্য, স্বপ্নগুলোকে আস্তে আস্তে মেরে ফেলতে ফেলতে জীবনের লড়াইটা একা লড়তে লড়তে অজান্তেই আসল মানুষটার বিসর্জন হয়ে যায়, পরে থাকে হাড্ডিগুড্ডি বা প্রাণহীন কাঠামোটুকু। তবু পদ্মারাই জিতে যায়, বিসর্জনের লড়াই, ভালোবাসার লড়াই। পদ্মার চরিত্রে জয়া আহসানকে যথাযথ বললেও কম বলা হয়। নাসের আলিকে দেখতে দেখতে ভুলেও গিয়েছিলাম স্ক্রিনে আসলে নাসেরের চরিত্রে আবীর চট্টোপাধ্যায়কে দেখছি। গণেশ মণ্ডলের চরিত্রে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় অনবদ্য, ওরকম একটি নেগেটিভ রোলেও যে তিনি নিজের বেস্টটূকু দিতে পারেন তারই প্রমাণ দেয় গণেশ মণ্ডল চরিত্রটি। যারা পরিচালক কৌশিকের ফ্যান ছিল তাদের এবার হয়তো অ্যাক্টর কৌশিকের ফ্যান হতে হবে। নিজের চেহারাকে ব্যবহার করে এক অন্যরকম চরিত্রের মোড়কে দর্শককে হাস্যরস উপহার দিতে পারেন একমাত্র কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়-ই। তথাকথিত নায়ক, নায়িকা, নেগেটিভ রোলের বৈশিষ্ট্যগুলোকে অনেক পেছনে ফেলে এসে তাদেরকে নিজের মত করে এঁকেছেন পরিচালক। এই ফিল্মের নায়ক স্মাগলিং-এর সাথে যুক্ত সে খারাপ কাজ করে, আবার তার মধ্যে ভালোটাও আছে।
নাসের আলি (আবীর চট্টোপাধ্যায়) |
ফিল্মের শুরুটা
দুই বাংলার দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্যে শুরু হলেও, ফিল্মের প্রত্যেক ভাঁজে
বিসর্জনের অর্থ পাল্টে যায়। এরকম একটা সময় যখন ধর্মের বর্মে গা ঢেকে রাজনীতির সুর
পাল্টাচ্ছে, যখন মানুষের মনে মনে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের বীজ গাঁথা হচ্ছে, শেখানো
হচ্ছে তোমার ধর্ম আমার ধর্ম আলাদা, আমাদের আগুন ভার্সেস তোমাদের মাটি, সেইরকম একটা
সময়ে ‘বিসর্জন’ সমস্ত ধর্মীয় ভেদাভেদের উর্দ্ধে উঠে মনুষত্বের সত্যি প্রতিষ্ঠা
করে। কারণ কেউ বলেছিল, ভালোবাসার থেকে বড় অস্ত্র আর কিছু নেই! এটাই হয়তো সব থেকে
ভালো জবাব হতে পারত। দুই বাংলার সংস্কৃতি, জীবন যাপন এসব কোনো কিছুকেই ফিল্মে বেশি
প্রাধান্য দেওয়া হয়নি, ব্যপারটা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত জানিনা। তবে যেহেতু আমার
খুব ভালো লেগেছে ধরে নিই, ইচ্ছাকৃতই। কারণ দুই বাংলার সত্যিই যে কোনো পার্থক্য হয়না,
গ্রাম বাংলার জমি মাটি সবুজ, আদর আপ্যায়ন সবই যে এক। ইছামতীও যে সবার, দেবীও যে
সবার। ভাষার টান ছাড়া সত্যিই কি দুই বাংলায় কোনো পার্থক্য আছে? ভালো লাগল, যখন ‘বিসর্জন’-এ
কোথাও বোঝা যায়না আমরা বাংলাদেশের পটভূমিতে ছবি দেখছি। মনে হল এ আমার দেশেরই চেনা
কোনো গ্রাম বাংলা হবে। সম্পূর্ণ যুক্তি তক্কোগুলোকে বাদ রেখে মনে করা যাকনা, আমরা
একটা ভালোবাসার ছবি দেখলাম। বিসর্জনের দিন দুই বাংলা এক হয়ে যায়, ‘বিসর্জন’-এও দুই
বাংলা এক হয়ে যায়। ‘বিসর্জন’ যেমন ধর্মের উর্ধে গিয়ে দুজন মানুষের রোম্যান্সকে
প্রতিষ্ঠিত করে, একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করে দুই বাংলার রোম্যান্সও...
খুব ভালো লাগলো রিভিউটা পড়ে।
ReplyDelete