সম্পর্ক প্রবাহমান অথচ ধীর গতি। এক সীমাহীন জলপ্রপাতের মতো। একটি নদী, যার পাড় ধরে আমরা সাত পা হাঁটতে পারি। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বিশাল মহীরুহের নিচে জিরিয়ে নিতে পারি। কিন্তু অন্তমিলে দুই জনের দেখা হয় না। জয় গোস্বামী তাঁর এক কবিতায় লিখেছিলেন, সাত পা হাঁটলেই বন্ধু হওয়া যায়। এক অপরের সঙ্গী হওয়া যায়, সম্পর্কে দোসর হওয়া যায়। আমি সেই সম্পর্কের কথাই আজ লিখছি।
ঋতুপর্ণ ঘোষের একাধিক ছবি আমার খুব প্রিয়, একাধিক ছবি অপ্রিয়। 'দোসর' অপ্রিয়র তালিকায় পড়ে না। বরং, কাবেরী ও কৌশিকের সম্পর্কের টানাপোড়েনে সাদা কালো এক জীবন প্রবাহকে খুঁজে পাই। যে জীবন শালিকের নয়, যে জীবন আমার। কলেজে পড়তে দোসর ছবিটি প্রথম দেখি। তারপর আবার গতকাল। ঋতুপর্ণর মা ও বাবা দুজনেই মারা যাওয়ার পর তিনি খুব একা হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময় রোববারের সম্পাদকীয়তে যখনই ঋতুপর্ণর ব্যক্তিজীবনের প্রসঙ্গ এসেছে, তখনই এসেছে একাকিত্ব ও এক ধীর গতি জীবন। যে জীবন চলতে চলতে একসময় গিয়ে থমকে গিয়েছে, অন্তমিলে দেখা মিলেছে নদীর। ওঁর ছবিতে একাকিত্বের সেই কবিতা বেশ উপভোগ করা যায়। দেখুন, কী যন্ত্রণাময় কিন্তু কাব্যিক। আহা, যন্ত্রণার এমন শিরোনাম দিলেই হত, নাম হত কবিতা।
চলচ্চিত্র নিজেই একটি মজার বিষয়। তাকে আলাদা করে বর্ণনা করতে হয় না। চলচ্চিত্রে একাধিক দৃষ্টিকোণ হয়। কখনও দর্শক দেখেন, কখনও দেখে সেই পরিসরের এক একটি চরিত্র। কখনও ক্যামেরা নিজেই একটি দৃষ্টি হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, ক্য়ামেরা আর তখন পরিচালকের অধীনে নয়। ক্যামেরা স্বাধীন। সে নিজের মতো ঘুরে বেড়াতে পারে ছবির পরিসরে। তরল দৃষ্টিকোণ বা লিকুইড পার্সেপশনের উদাহরণে ক্যামেরার এরকম মুভমেন্ট বা গতির কথা উল্লেখ করেছিলেন গিলস দেলেউজ। হয়তো চরিত্ররা নিজের মতো কথা বলছে, তাদের কাজ করছে। কিন্তু ক্যামেরার চরিত্রদের অনুসরণ করার কোনও দায়বদ্ধতা নেই। সে স্বতন্ত্র। সে পরিসরে উপস্থিত কিন্তু দৃশ্যের উপর দায়বদ্ধ নয়। দোসরের বেশ কয়েকটি দৃশ্য় স্বতন্ত্র সেই ক্যামেরার উপস্থিতি মনে করিয়ে দেয়। যখন কৌশিক ও মিতা হোটেলের ঘর ছেড়ে আসার পর হোটেলকর্মীরা ঘরে কাজ করছে। তখন ক্যামেরা মুভমেন্ট ক্যামেরার উপস্থিতি যেন স্পষ্ট করে দেয়। দীর্ঘ কথোপকথনের পর কাবেরী তাঁর মায়ের বাড়ি থেকে ফিরে আসছে। নির্দিষ্ট দৃশ্য়ে ও পরিসরে দুই চরিত্র ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। পরিসরে কোনও চরিত্র নেই। কিন্তু ক্যামেরা তখনও স্থির সেই একই স্থানে। এক শূন্যতা অনুভব করে ও করায়। এটি কার দৃষ্টিকোণ জানা নেই, তবে স্থির নয়, তরল।
কয়েকটি নির্দিষ্ট পরিসর, কয়েকটি চরিত্র এবং কয়েকজন চরিত্র নিয়ে একটি সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য যে তৈরি করে ফেলা যায়। তা ঋতুপর্ণ বার বার প্রমাণ করেছেন। তাঁর ছবির মূল বৈশিষ্ট্যই ছবির সংলাপ ও দৃশ্য সংগঠন। প্রতিটি দৃশ্য এত নিখুঁত ভাবে তৈরি। বদ্ধ পরিসরও যে সুন্দর দৃশ্য তৈরি করতে পারে, সংলাপ ও আবহের সাহায্য়ে শব্দ গঠন হতে পারে। তা বোঝার জন্য দোসরের প্রতিটি দৃশ্য়ই যথেষ্ট উদাহরণ।
স্নানঘরের দৃশ্য়ের আলোচনায় আসি। কাবেরী ততক্ষণে কৌশিকের বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের বিষয়ে জানে। কিন্তু কৌশিক অসুস্থ। সদ্য হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। কৌশিকের মধ্য়েও সম্পর্কটা ঠিক করে নেওয়ার এক তাগিদ রয়েছে। কাবেরীকে ফিরে পাওয়ার তাগিদ রয়েছে। কিন্তু প্রথমেই লিখেছিলাম, সম্পর্ক সীমাহীন জলপ্রপাত। কখনও কখনও ভালোবাসার কথা বোঝানোর জন্য নৈঃশব্দের প্রয়োজন পড়ে। নির্ভরশীলতা বোঝানোর জন্য স্পর্শ প্রয়োজন পড়ে। কৌশিক অসহায়ভাবে স্নানঘরে কাবেরীর হাত চেপে ধরে। মুখে কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। তাঁর যন্ত্রণা, তাঁর অনুতাপ, তাঁর প্রেম স্পর্শের কাছেই নত।
এত নিখুঁত দৃশ্যগঠনের প্রশংসা করতেই হয়। তবে কাবেরীর মধ্য়েও যন্ত্রণা কম নয়। তাই হাত সরিয়ে নেয় সে। হয়তো এখানেই চিত্রনাট্যকারের দক্ষতা ও পরিচালকের মুনশিয়ানা। কৌশিক প্রশ্ন করে, "কিছু জানতে চাও না তুমি?" কাবেরী উত্তর দেয়, "কিছু জানার নেই।"
ছবির গল্প খুবই সাধারণ। বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরিরত কৌশিক (অভিনয়ে - প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে ডায়মন্ডহারবার থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। ঘটনাস্থানেই বান্ধবীর মৃত্যু হয়। কৌশিককে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। সেই সময়ই তাঁর স্বামীর বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের কথা জানতে পারেন। কিন্তু এই সাধারণ গল্পের দৃশ্য়গত উপস্থাপন বিষয়টিকে অন্য় মাত্রা দিতে পারে। একটি আহত সম্পর্ক আবার সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। সুস্থ হওয়ার জার্নিটা দীর্ঘ। এই জার্নিটাই চিত্রনাট্য, দৃশ্য...সিনেমা।
দোসর অর্থাৎ একে অপরের সঙ্গী, টানাপোড়েনে পাশে থাকা, অসহায়তায় বন্ধু হওয়া। প্রথমেই সম্পর্কের নদীর কথা লিখেছিলাম। সেই নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি আসে। সেই পথচলা হয়তো মনোক্রমিক। যেমন হাসপাতালের কেবিনের বাইরে অপেক্ষারত কাবেরী। ট্রেনের গতি ও আওয়াজে যার ভাবনা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়। আর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয় স্বামীর লাগেজে তাঁর বান্ধবীর স্মৃতিতে। ভালোবাসার খোঁজে পথ হারানো রাজকুমারী বিশাল মহীরুহের নিচে জিরিয়ে নেয়। ক্লান্তির কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিয়েছে রাজপুত্র। একে অপরের ঠোঁটে আশ্রয় হয়ে খুঁজে পেয়েছে নিজেদের, কাবেরী ও কৌশিক; দোসর।
ছবি সৌজন্য - দোসর
ছবি পরিচালক - ঋতুপর্ণ ঘোষ
No comments:
Post a Comment