এই সময় বিশ্বভারতীকে বাঁচানোর, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে
বাঁচানোর
শাসকপক্ষ বারবার বলে, শিক্ষাক্ষেত্র রাজনীতির পরিসর নয় । তবে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার জাগরণ কোথায় হবে ? একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রমনের যদি রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রতই না হয়, তবে সেই শিক্ষাই অসম্পূর্ণ । বিশ্বে অরাজনৈতিক কোনও ধারনার অস্তিত্ব নেই । একটি ছাত্রমনই প্রশ্ন করবে, অধিকারের জন্য লড়বে । নিজের মৌলিক অধিকার ও দায়িত্ব বুঝে আরও চার-পাঁচজনের কথা ভাববে । দারিদ্র, অন্যায়, অনাহার যদি তাকে না ভাবায় তাহলে সে কি আদৌতে শিক্ষার আলোকে আলোকিত হয়েছে ? কিন্তু ফ্যাসিবাদী সরকার কখনওই চাইবে না, তাদের কাজের বিরুদ্ধে কেউ প্রশ্ন করুক । তারা কখনওই চাইবে না, শিক্ষার্থীরা মৌলিক অধিকার বুঝে নিক । মানুষের কথা ভাবুক, মানুষের জন্য লড়ুক । বিজেপি সরকারের যে কোনও সিদ্ধান্তের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত সরব হয়েছে । সবথেকে বেশি সরব হতে দেখা গিয়েছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেই । নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হওয়ার পর জামিয়া, জেএনইউ, যাদবপুর, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন । আওয়াজ তুলেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে । এসেছে কবিতা, গান, স্লোগান । শাসকগোষ্ঠী ফিরিয়ে দিয়েছে বুলেট, লাঠি ও অত্যাচার । কিন্তু সেই আন্দোলন থেমে যায়নি । একইভাবে শাহিনবাগ আন্দোলনে ও দিল্লি দাঙ্গার সময়েও ছাত্র-ছাত্রীদের সরব হতে দেখা গিয়েছে । দেখা গিয়েছে দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতিবাদের সুর সবথেকে জোরালো । কারণ, শিক্ষার আলো সেইসব ছাত্রমনকে ছুঁয়েছে । মানুষের কথা ভাবতে শিখিয়েছে, মানুষের পাশে দাঁড়াতে শিখিয়েছে । রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার স্পর্ধা দিয়েছে । এই স্পর্ধা জন্ম জন্মান্তরের, প্রকৃত শিক্ষা সঠিক রাস্তা চিনিয়ে দেয় কেবল...
চলতি বছরে 5 জানুয়ারি একইভাবে জেএনইউ ক্যাম্পাসে ঢুকে ঐশীকে মারে এবিভিপির গুণ্ডারা । অন্যান্য পড়ুয়া ও অধ্যাপকদেরও মারধর করা হয় । ক্যাম্পাসে ভাঙচুর চলে । জামিয়ার মিছিলে ছাত্রকে গুলি করে এক দুষ্কৃতী । সেইসময়ও পুলিশ ঘটনাস্থানে ছিল ও দাঁড়িয়ে দেখছিল । আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, দিল্লির পুলিশ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে ।
প্রত্যেকটা ঘটনা থেকে এই বিষয় পরিষ্কার যে, বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকেই লক্ষ্য করেছে দক্ষিণপন্থীরা । রাষ্ট্র ছাত্র-ছাত্রীদের কণ্ঠরোধ করার জন্য চূড়ান্ত পদক্ষেপ করেছে বারবার । কিন্তু কেন ? আমরা ভেবে দেখেছি ?
প্যানডেমিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সিবিএসই-র পাঠ্যক্রম থেকে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মতো বিষয়কে বাদ দিয়েছে কেন্দ্র । নতুন শিক্ষানীতি আরোপ করেছে । পুরাতন শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে দিতে চেয়েছে । দেশে এক নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে চেয়েছে , কেন? কারণ আমরা ভেবে দেখিনি । তবে যদি এখনও ভেবে না দেখি, তবে আর কবে ভাবব ? কারণ এইবার আঘাত এসেছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর । সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন চলছিলই, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরকে নিয়ন্ত্রণাধীন করতে চাইছে বিজেপি সরকার । আমরা রবীন্দ্রনাথের ভাবধারায় নিজেদের ভাসিয়ে দিতে পারিনি বলেই জ্ঞানের সেই আলোক আমাদের এখনও ছুঁয়ে যেতে পারেনি । পূজা পর্যায়-প্রেম পর্যায়ের মধ্যবর্তী বিভাজন রেখা আমাদের মনে বিলীন হয়ে যায়নি । প্রেমে ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে পারিনি তাই ! সাধারণত হিন্দুত্ববাদীরা পশ্চিমী শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিরোধী হয় । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন গড়ে তোলা, ছাত্র-ছাত্রীদের মুক্ত পরিসরে শিক্ষা দেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল বিদেশের ও দেশের শিক্ষার এক মিলন । খোলা আকাশের নিচে বদ্ধ পরিসরের বাইরে অধ্যাবসায়ের লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল শান্তিনিকেতনের পথ চলা । আমরা বাংলা সাহিত্যে এমনকী বিদেশী সাহিত্যেও তার উল্লেখ পেয়েছি । রবি ঠাকুরের লেখায় তার উল্লেখ পেয়েছি । সেই শান্তিনিকেতন সেই বিশ্বভারতীকে অধীনস্থ করার চেষ্টা চলছে । পৌষমেলার মাঠে পাঁচিল দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে । ছাত্র-ছাত্রীরা বারবার তার বিরোধিতা করেছেন । আওয়াজ তুলেছেন, শান্তিনিকেতন বাঁচাও । এখন সত্যিই আমাদের শান্তিনিকেতন বাঁচানোর সময় ! শান্তিনিকেতনের কোনও বাঁধা পরিসর নেই, থাকতে পারে না । শাসকগোষ্ঠী বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি , বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার আছে পাঁচিল দেওয়ার ! রাজ্যপাল রবি ঠাকুরের উপমা টানছেন । রবি ঠাকুরের স্বপ্নকে আঘাত করে তাঁর কথাই উল্লেখ করার স্পর্ধা কীভাবে হয় এঁদের আমি জানি না ।
স্থানীয় লোকজন ও রাজ্যের শাসকদলের কয়েকজনের নামও পাঁচিল ভাঙার ঘটনায় জড়িয়েছে । বিশ্বভারতীর ঘটনাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে বিজেপি । যারা মানুষ বলতে ধর্ম বোঝে, বিভেদ বোঝে, হিংসা বোঝে...তারা শান্তিনিকেতনের পরিবেশ উপলব্ধি করবে কীভাবে ? রবীন্দ্রনাথের বোলপুর-শান্তিনিকেতনের লালমাটি যারা ছুঁইয়েই দেখেনি তারা কী বুঝবে আদিবাসী গান ! তারা কীভাবে চিনে নেবে খোয়াইয়ের পথ ! বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি নষ্ট করাতে যদি রাজ্যপাল এতই উদ্বিগ্ন হন তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তছনছ করার সময় তিনি চুপ করেছিলেন কেন ? এখন সত্যিই শান্তিনিকেতন বাঁচানোর সময়, বিশ্বভারতী বাঁচানোর সময় । মানব বন্ধন হয়ে ক্যাম্পাস আগলে রাখতে হবে আমাদেরই । ওরা আসবে, ওরা মারবে । কিন্তু আমাদের মানব বন্ধন ভাঙলে চলবে না । কারণ এই শান্তিনিকেতন আমাদের, বিশ্বের । এক স্বাধীনতার স্বপ্ন, মুক্তির স্বপ্ন, মুক্ত শিক্ষার স্বপ্ন । ওই দাঙ্গাবাজদের নয় । নিজেদের জীবনকে ওরা রবীন্দ্রনাথ দিয়ে বেষ্টিত করতে পারেনি, তাই শিক্ষাপরিসরকে ঘিরে ফেলতে চাইছে !
বিশ্বভারতী, যাদবপুর, জেএনইউ এক একটা উদাহরণ মাত্র । আসলে দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই কবজায় করতে চায় ওরা । কারণ শুধু এই প্রজন্ম নয়, আগামী প্রজন্মকেও পঙ্গু করে দিতে চায় । ফ্যাসিবাদী সরকার প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থাকে লক্ষ্য করবে, কারণ সেইখানেই তৈরি হয় বিরোধী মন । ছাত্র-ছাত্রীদের রাষ্ট্রের সামনে দেশদ্রোহী প্রমাণ করতে চাইবে কারণ তাঁরাই প্রশ্ন করার স্পর্ধা দেখায় । যার উত্তর দেওয়ার হিম্মত শাসকপক্ষের নেই । ওরা কী চায় ? একটা পঙ্গু সমাজ ব্যবস্থা, যারা প্রশ্ন করতে জানে না । যারা অনুসরণ করে । এই সময় বিশ্বভারতীকে বাঁচানোর, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বাঁচানোর । এক ব্যারিকেড যা ঘিরে থাকুক শিক্ষাব্যবস্থা-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান । অন্তত শাসকগোষ্ঠী যেন সেই পরিসরে আঘাত না করতে পারে, ভাঙতে না পারে সেই ব্যারিকেড । রক্ত দিয়ে তৈরি ব্যারিকেড, স্পর্ধা ও শিক্ষার আলোকে তৈরি ব্যারিকেড...জীবন থাকতে যেন সেই ব্যারিকেড ভেঙে না পড়ে...