যতবার শহর ছেড়ে এসেছি, একটা দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়েছে । সেই এক অদ্ভুত
দুঃস্বপ্ব, যার কোনও শেষ নেই । একটা শুরু আছে কেবল । অন্তহীন এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে
রয়েছি । মা’কে ছেড়ে থাকার কষ্ট
এবং শহর ছেড়ে আসার অনুভূতিটা অনেকটা একরকম । আমার দোতলার ঘর, বারান্দার ফুল গাছ
আর কাচের ভিতর রাখা রঙিন মাছ এসবই বাড়ি ছেড়ে আসার আগে শেষবারের জন্য স্মৃতির
সঙ্গে সময় কাটাতে জোর করে । আমাদের নিচের ঘর, বাবার শার্টের বোতাম অনেক পুরাতন
হয়েছে । তার থেকেও পুরাতন হয়েছে বার্মা সেগুনের খাটটা । যদিও আমার কাছে সবথেকে
পুরাতন নিচের ঘরের আলমারিটা, যার মধ্যে রাখা মায়ের গন্ধ । যে শাড়িগুলো ছুঁলে মনে
হয় মা’কে ছুঁয়ে দেখলাম ।
মায়ের চেয়ে আদিম এই পৃথিবীতে কী আছে, আমার জানা
নেই ।
আজও এইখানে বৃষ্টি এল । বিকেলে কাজ করার সময় মেঘ করে এল , মনে হল এইতো মন খারাপ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের জলে নৌকা ভাসানো যাবে । হঠাৎ করেই বাড়ি ছেড়ে আসার দিনটার কথা মনে পড়ল । ভোরবেলা এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য যখন গাড়িটা পাড়ার মধ্যে থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়টা । আমি পিছনে ঘুরে বাবাকে দেখার চেষ্টা করছি, যতদূর বাবাকে দেখা যায় । বাবাও দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে । এর থেকে যন্ত্রণার সময় আর হয় কি, জানা নেই । আমার ঠাম্মার সঙ্গে গল্প, আর নির্ভেজাল সন্ধ্যাগুলোর কথা মনে পড়ল । আমি কাগজের নৌকা বানালাম । বৃষ্টি নামতেই স্মৃতির নাম ওদের গায়ে লিখে ভাসিয়ে দিলাম, ওরাও নিজের মত ঠিকানা খুঁজে নিচ্ছিল । কেউ মায়ের শাড়ির আঁচলে মুছে নিচ্ছিল চোখ, কেউ বাবার সবথেকে পুরাতন শার্টের বোতাম চুরি করে পকেটে ভরছিল, কেউ ঠাম্মার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ছিল কিছু না ভেবেই । আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ঠায় বৃষ্টির জলে ভাসছি, আর দেখছি নৌকারা খুঁজে নিচ্ছে নিজেদের ঠিকানা । আমি এখনও বুঝিনি, আমায় হায়দরাবাদের ফ্ল্যাটের ছাদ বেশি প্রিয় না কি বাড়ির বারান্দা । আমার বইয়ের তাক বেশি প্রিয় না কি এক কামরার ভাড়ার এই ছোট্টো ফ্ল্যাটটা । আমি বুঝিনি আমার প্রিয় বন্ধুর নাম কী, আমি এখনও খুঁজে পাইনি আমার প্রেমিকের ঠিকানা । শুধু জানি, কোনও এক পাহাড়ি গ্রামে সেও তাঁর গিটার কাঁধে মেঘলা দুপুরের গান গায় । তারা দেখে রাতের আকাশ, বৃষ্টি হলে ছাদে ঘুরে আসে । আর জোৎস্নার রাতে ফিরে যায় জঙ্গল । আমি এখনও নিজেকে খুঁজি । বইয়ের পাতায়, খবরের নৃশংসতায়, আর রাত জাগা ফোনে । হয়তো আমিও সেই মনটাই হতে চেয়েছিলাম যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে । যার নাম হারিয়ে গেছে হাওয়ায় ।
এই বর্ণবিদ্বেষের পৃথিবীতে... দারিদ্র, যন্ত্রণা, বেকারত্ব, আত্মহননের পৃথিবীতে... এই অসাম্য আর ক্ষমতার লড়াইয়ে দুটো ডানার প্রয়োজন ছিল । যে ডানা দুটো বৃষ্টির জলেও ভেজে না । যে পাখিরা উড়ে যায় ঘর ছেড়ে, ফিরে আসে আরও এক দুই তিন শতক পর । আর পুরাতন গানদের বন্ধু বানিয়ে প্রত্যেকের রূপকথার গল্প লেখে তারাই । রাজকুমারির জন্য দেড়শো বছরের পুরাতন গান নিয়ে হেঁটে বেড়ায় পথিক প্রেমিক । বাঁশি বাজায় আপন মনে, কিন্তু তাঁদের দেখা হয় না । অথচ, নন্দিনী ও বিশু পাগলের মত তারাও চিরন্তন । হয়তো সেই রূপকথা এখনও লেখা বাকি । এখনও বৃষ্টি আসা বাকি আরও অনেক । এখনও জোনাকিদের ঘুমাতে যাওয়া বাকি । এখনও সব তারারা পড়েনি খসে ।
কিন্তু আমরাও স্বপ্ন দেখবই । আমরা বলবই--- ভাবো, যে পৃথিবীতে কোনও দেশ নেই । মা’কে ছেড়ে থাকার দুঃখকে সঙ্গে নিয়ে থাকব, কারণ অনেক দুঃখ যা ভোলার মত দুঃখ নেই । কয়েকটা যন্ত্রণা আপন হয়, শীতের সেই দুঃস্বপ্ন়টাও সেই একইরকম । যাকে ভোলার জন্য এখনও বৃষ্টি হলেই শহর টানে, এখনও মেঘলা আকাশ উড়িয়ে আনে চিঠি । আমি একের পর এক নৌকা ভাসাই, ট্রলি ব্যাগ থেকে বের করে নিই মায়ের শাড়ি । জানি, ঘুম থেকে উঠেই দেখব মা ফিরে এসেছে আরও এক মেঘলা বিকেল হয়ে ... খসে গিয়েছে আরও একটা তারা ... টবের গাছে নতুন ফুল এসেছে পরবর্তী সকালে ...
No comments:
Post a Comment