১
শহরে ল্যান্ড করল মিছরির ফ্লাইট । আজ প্রায় তিনবছর পর আবার শহরে ফেরা । ফ্লাইট
মোড অফ করতেই হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ এল --- “Reached?” মিছরি উত্তর দিল, “just landed.
I’ll call you.” এখনও কুয়াশার ঘুম কাটেনি কলকাতার । এয়ারপোর্টের অধিকাংশই আবছায়ায় । বেশ শীত করছে । প্লেন থেকে
নেমে লাগেজ বেল্টের কাছে এগিয়ে গেল । ফোনের নিউজ় অ্যাপটা খুলল । উত্তর-পূর্ব
দিল্লিতে দাঙ্গায় এখনও পর্যন্ত মৃত 40 । গত দু’রাত এক ফোঁটাও ঘুম
আসেনি । যতবার চোখ বন্ধ করেছে , ফিরে এসেছে আগুন । বাড়িগুলো জ্বলছে । সারিসারি
মৃতদেহ পড়ে রয়েছে রাস্তায় । রাতে ঘুম না এলে আগে খুব একা লাগত । এখন ঘুম না এলে
হোয়াটস অ্যাপ খুলে মেসেজ টাইপ করে --- “জেগে আছিস?” ওইদিক থেকেও উত্তর আসে, “ঘুম আসছে না ?” মিছরি কখনও কারোর উপর নির্ভরশীল হতে চায়নি । তবে ইদানীং ওর মনে হয় কোনওভাবে কি ও নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে ।
পাঁচ বছর আগে কলকাতার এক ফিল্ম স্কুলে অ্যাডমিশনের ওরিয়েনটেশনে আলাপ হয়েছিল
সৌভিকের সঙ্গে । ফিল্ম স্কুলের সেইবছরের মেরিট লিস্টে নাম আসেনি মিছরির । সৌভিকের
অ্যাডমিশন হয়েছিল । এরপর মিছরি সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করে । একদিন ভোরের ট্রেনে
শহর ছাড়ে । নিজের কাছেই প্রমিস করেছিল আর কোনওদিনও শহরে ফিরবে না ও । অথচ, এই
কলকাতাই মিছরির বড় প্রিয় । প্রত্যেকটা রাস্তা, প্রত্যেকটা গাছ, ভিড় এসব কিছুই
আপন । আর সবথেকে প্রিয় ছিল ওর য়ুনিভার্সিটির ক্যাম্পাস । ক্যাম্পাসের প্রত্যেকটা
কৃষ্ণচূড়া গাছ, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির রিডিং রুম ।
লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হল মিছরি । নেহাকে ফোন করল । কলার টিউনে বাজছে জন ডেনভারের একটা গান, ‘কান্ট্রি রোড টেক মি
হোম...টু দ্য প্লেস আই বিলং ।’
--- হ্যাঁ বল সুপর্ণা ।
--- নেহা আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরোলাম । কোন বাসে উঠব তোর বাড়ি আসার জন্য ?
--- এসি 37(এ) –এ ওঠ । দেখ এয়ারপোর্টের বাইরেই বাসস্ট্যান্ড । কাউকে জিজ্ঞেস
কর ।
--- হ্যাঁ দেখতে পেয়েছি । ঠিক আছে রে, পাটুলিতে নেমে তোকে ফোন করছি ।
ফোন কেটে দিয়ে বাসে উঠল মিছরি । কিছুক্ষণ পর বাস ছাড়ল । তিন বছরে কী
পাল্টিয়েছে শহরটায় ? দুইদিনের জন্য শহরে ফেরা,
তারপর আবার যন্ত্রের মত জীবনযাপন । এই জীবনটাই কি চেয়েছিল মিছরি নাকি একটা পাখির
মত হতে চেয়েছিল । স্বপ্ন দেখতেই ভালবাসত ভীষণ । এখন স্বপ্নগুলোকে চাইলেও ছুঁয়ে
দেখতে পারে না । কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে । ঘুম ভাঙল সৌভিকের ফোনে ।
--- হ্যাঁ বল সৌভিক ।
--- কোথায় তুই এখন ।
--- বাসে, এসআরএফটিআই-র সামনে । স্বপ্নের পৃথিবীর গেটের সামনে দিয়ে যাচ্ছি ।
--- তুই এখনও সেসব ভাবিস ?
--- কেন ভাবতে বারণ আছে না কি ?
---- আরে না না । তোর সঙ্গে
দেখা হওয়ার অপেক্ষা করছি ।
--- আমার জন্যেও কেউ অপেক্ষা করে তবে । মুম্বই থেকে হঠাৎ শহরে এলি কেন ? এই মাসে ছবির কাজ নেই ?
--- তুই এলি কেন ? বলব বলব ছবির কাজ কী আছে ।
খুব অপেক্ষা করছি সুপর্ণা ।
--- কথা তো ছিলই দেখা হবে । তাই এলাম । কাল দেখা হবে । আগামীকাল সন্ধেয় ফ্লাইট
।
--- সে কী ? আর থাকবি না ? একদিনের জন্য ?
--- এই শহরে বেশদিন থাকা আমার জন্য ভাল না সৌভিক । তোকে কথা দিয়েছিলাম তাই
এলাম । চল রাখি । পাটুলি এসে গিয়েছি ।
--- পাটুলি কেন ? বাড়ি যাবি না ?
--- চল টাটা ।
বাস থেকে নামল মিছরি । নেহার থেকে ঠিকানা জেনে নিয়ে রাস্তা পার হল ।
নেহার এই নতুন ফ্ল্যাটটা বেশ সুন্দর । দরজা খুলেই মিছরিকে জড়িয়ে ধরল নেহা ।
মিছরির চোখেও জল এল ।
২
ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ খেল । নেহা ওর জন্য
পছন্দের পদগুলো রান্না করেছিল । ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, চিঙড়ি মাছ । অনেকদিন পর আজ
কেউ যত্ন করে রান্না করেছে ওর জন্য । নেহা ওকে খুব ভালবাসে ৷ পৃথিবীতে মিছরিকে যদি
কেউ সবচেয়ে বেশি বুঝে থাকে, সে নেহা । মিছরি
কিছু না বললেও ওর মন পড়ে ফেলতে পারে ৷
প্রিয় সিনেমা থেকে প্রিয় কবিতা সবেতেই ওদের ভীষণ মিল । আর
ওরা ভালবাসে স্বাধীনতা, এক
স্বাধীন জীবনযাপন ।
দেশে এখন খুব কঠিন এক পরিস্থিতি । সেই ডিসেম্বর মাস থেকে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে । নাগরিকত্ব
সংশোধনী আইন আসার পরেই দেশটা কেমন দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল । ওরাও তো ওটাই চেয়েছিল । ধর্মীয়
সংখ্যালঘু মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন যদি করে দেওয়া যায় । মিছরি
জানে এরা প্রশ্ন পছন্দ করে না, এরা
চায় অনুসরণ । মানুষ অন্ধের মত অনুসরণ করবে । আর
এইদিকে মিছরির মত যারাই প্রশ্ন করতে চাইবে তাদের ডানা ভেঙে ফেলে দেওয়া হবে । ৫
জানুয়ারি জেএনইউ ক্যাম্পাসে ঢুকে মেরে গেছে ওরা । আর
শাহিনবাগ...লড়ছে । অস্ত্রের বিরুদ্ধে শান্তি হয়ে লড়ছে । অধিকারের
জন্য লড়ছে । মিছরিরাও পাশে আছে ওদের । তবু
মিছরির খুব ভয় হয় এখন...মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে যায় সেইদিনটার কথা । ভয়ে
চোখ বন্ধ হয়ে আসে । উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে এক ভয়াবহ
পরিস্থিতি এখন । নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সপক্ষ ও বিপক্ষ । ওরা
লড়ছে । মরছে মানুষ । মৃতদেহ
দেখলে মিছরির কান্না পায় ৷ যুদ্ধ শুনলে মিছরির কান্না পায় । কাউকে
বলতে পারে না । স্মৃতি ওকে প্রতিদিন কাঁদায় । এই
শহর ওকে প্রতিদিন কাঁদায় । মিছরি পালিয়ে বেড়ায় ।
৩
নেহার এই এক কামরার ফ্ল্যাটটা খুব সুন্দর । নেহা
মনের মত সাজিয়েছে । সবথেকে সুন্দর ওর বারান্দাটা । আলো
জ্বলে । ফুলগাছ রাখা । মনে
হয় রূপকথার কোনও এক পৃষ্ঠা
। পক্ষীরাজ নেমে আসবে এখনই, স্বপ্নের কাছে নিয়ে যাবে
ওদের । মনেই হয় না, দেশের আর এক প্রান্তে মানুষ
মানুষকে কাটছে । এক উগ্র জাতীয়তাবাদ দেশটাকে একটু একটু করে গ্রাস
করছে ।
ওলড মঙ্ক ওদের দুজনেরই খুব প্রিয় । গ্লাসের
ওলড মঙ্ক একটু একটু মত্ত করছে সন্ধেটা । নেহার
প্রিয় সুমন , ঘরে বাজছে তাঁরই গান ।
" সুপর্ণা
তুই কি কোনওদিনও বাড়ি ফিরবি না?", জিজ্ঞেস করল নেহা । মিছরি
মাথা নেড়ে না জানাল ।
--- কেমন কাটছে নতুন শহরে ?
তিনবছরে একবারও আমার কথা ভাবলি না । দেখা করতে এলি না । এখন কার একটা প্রেমে পড়ে চলে এলি
হুম ?
--- প্রেম
? তুইও তাই বলবি নেহা ? তুই তো জানিস আমি কেন শহর ছেড়ে গিয়েছিলাম । আজ়িফ ছাড়া জীবনটা
কখনও ভাবতে পারিনি । তোর মনে আছে ও কী সুন্দর ছবি আঁকত ।
--- মনে
আছে । আমাদের য়ুনিভার্সিটির জীবনের প্রত্যেকটা সময় মনে
আছে । তোদের কথা মনে আছে। আমাদের স্বপ্নের কথা এখনও
মনে পড়ে ।
--- আমার কান্না পায় নেহা । মনে
হয় বাঁচব না । মনে হয় একদিন আবার সব ঠিক হয়ে যাবে । তাঁরা সবাই ফিরে আসবে যাঁরা হারিয়ে গিয়েছিল ।
কান্নায় ভেঙে পড়ল মিছরি । নেহা
ওকে জড়িয়ে ধরল । মাথায় হাত বুলিয়ে দিল । "এসব আর ভাবিস না সুপর্ণা । আমরাও
ভাবি না আর । ওরা কেসটাকে পুরো অন্যভাবে সাজালো, ওর
মা থানায় অভিযোগ করতে গেলে ওঁকে মারধর করে বাড়ি পাঠানো হল । কোনও
মিডিয়া কভারেজ হল না । আমাদের বন্ধু!
আমরা ভাবতেও পারি না । মুক্ত পাখির মত একটা ছেলে । সারাদিন
তোর সঙ্গে...আর ভাবিস না সুপর্ণা! আমরা আছি । একদিন
সব ঠিক হবে দেখিস । "
চোখের জল মুছে গ্লাসে রাম ঢেলে নিল মিছরি । "ওর
দোষ কী ছিল জানিস নেহা, ও প্রশ্ন করেছিল! আমার এদের ঘেন্না হয় । করুণা
হয়। ", মিছরি
বলল । নেহা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল । নেহার
কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল মিছরি ।
--- আমরাও কি মিছিলে হাঁটিনি নেহা ?
আমরাও কি মানুষের জন্য ভাবিনি? আজ দেশটা কেমন দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল । মৃত্যুতে
আমার ভয় লাগে ৷ ওঁর কথা মনে পড়ে ।
বৃষ্টি এল হঠাৎ । জলের
ছাঁট এসে লাগছিল মিছরির চোখেমুখে । চোখ বন্ধ করে ও দেখতে পাচ্ছিল ক্যাম্পাসের মাঠ । সেদিনই থার্ড সেমেস্টার শেষ হয়েছে । ওরা
দুজন বসে আছে । সেইদিন
আকাশে অনেক তারা । একটুও মেঘ নেই । কাল বাড়ি ফিরে যাবে আজ়িফ । মিছরির
হাত ধরে ও বলল, " শীতকাল
কবে আসবে সুপর্ণা, তিন
মাস ঘুমিয়ে থাকব!" মিছরি ওকে
ধাক্কা দিয়ে বলল, এসব বলে নাটক করিস না । মিছরির
কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল ও । বলল, "এই যে এইখানে তো ! কয়েকটা
দিন আমার বাড়িতে সময় দেওয়া প্রয়োজন । হস্টেলেও আর ভাল লাগছে না । এখনও রাগ করবি ? চলে আসব দেখিস দুই সপ্তাহ পরেই ।"
মিছরি ওর মাথায় হাত রাখল । ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল, “তিন
সত্যি ? খুব বেশিদিন আমি তোকে না দেখে থাকতে পারি না তুই
জানিস । তাড়াতাড়ি আসবি কথা দে । তুই ছাড়া ক্যাম্পাস আমি ভাবতেও পারি না ।” ও মিছরির হাত ধরে বলল, “কথা দিলাম বাবা । এবার একটা
গান শোনা ।” মিছরি গাইতে শুরু করল, “আভি না যাও ছোড়কার...কে দিল আভি ভরা
নেহি...”
হঠাৎই আজ়িফের হস্টেলের বন্ধুরা এল । ওদের মধ্যে থেকেই একজন বলল, “তুই এখানে প্রেম করছিস ? ওইদিকে ওরা তোকে খুঁজছে ।
হস্টেলে দলিত পরিবারের নতুন যে ছেলেটি এসেছে, ওর থাকা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে । এখনই চল
।” মিছরির কোল থেকে মাথা তুলে
নিল ও । উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল । মিছরির দিকে হাত নেড়ে বলল, “আসি এখন । পরে দেখা হবে । তুই সাবধানে চলে যাস ।” এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে চলে গেল । ঘুরেও তাকাল না । মিছরি জানত, ওর সহপাঠী
ওর সংগঠনের এই ছেলেটি ক্যাম্পাসে মিছরির পরিচিতি একটু একটু করে কমিয়ে ফেলছে । কখনও
ভাল প্রেমিক হতে পারেনি । তাও ওকেই খুব ভালবাসে মিছরি । সেইদিন ফাঁকা মাঠে একা
দাঁড়িয়েছিল । ঝাপসা হয়ে এসেছিল ক্যাম্পাস । চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল । চোখ
খুলে বাইরে তাকাল মিছরি । তখনও বৃষ্টি পড়ছে । নেহার বারান্দার আলো জ্বলছে
নিভছে । মিছরির কান্না এল, এই শহর ওর থেকে নিয়েছে, ফিরিয়ে দেয়নি কিছু ।
--- নেহা তোর
সৌভিককে মনে পড়ে ? শিলিগুড়ির ছেলেটা । ফিল্ম
স্কুলে আলাপ হয়েছিল । ওর সঙ্গেই কাল দেখা করব!
--- হ্যাঁ। বলেছিলি,
মনে পড়ে অল্প । বেশ তবে দেখা কর । ভাল
তো । আমরাও চাই । এখন
খেয়ে নিবি চল...
৪
চাঁদনি মেট্রোর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মিছরি । অল্প
বৃষ্টি পড়ছে । ও চেষ্টা করছে বৃষ্টির জল এড়িয়ে যেতে । সৌভিককে ফোন করছে, সে ধরছে না । একটা ক্যাব সামনে এসে দাঁড়াল । সৌভিক
নামল । মিছরির কাছে এগিয়ে এল । বলল, "আরে
বলিস না! শেয়ারড ক্যাব তো দেরি হয়ে গেল । চল
রাস্তা পার হই!" মিছরি তাকিয়ে হাসল । দুজনে
ব্রডওয়েতে ঢুকল । রাস্তার দিকে জানলার পাশে একটা টেবিলে বসল । পাঁচ
বছর পর ওদের দেখা । একটু অপ্রস্তুত বোধ করছিল । আইসব্রেক
করল সৌভিকই ।
--- বল
সাংবাদিকতা কেমন চলছে?
--- তোর
ছবি বানানো কেমন চলছে বল আগে!
--- ছবি
কই বানাচ্ছি, ডিরেকশন
টিমে কাজ করছি আর কী! নিজের পরিচিতি তৈরি করব কীভাবে তাই ভাবছি । বিয়ার
খাবি?
--- ঠান্ডায়?
--- বল না, খাবি? সারাক্ষণ রাম খেতে হবে না । ঠান্ডা
লাগলে ডাক্তার দেখানোর দায়িত্ব আমার ।
মিছরি হাসল । সৌভিক
দুটো বিয়ার অর্ডার দিল । আর ড্রাই চিলিচিকেন। " আমার সাংবাদিকতা ঐ চলছে । খবর
সম্পাদনা করছি, সেরকম থ্রিল কই ! তুই বল কী বলছিলি !"
--- হ্যাঁ । এই ফিল্ডে নিজের
পরিচিতি তৈরি করাটা খুব প্রয়োজন । ইন্ডাস্ট্রিতে সার্ভাইভ করতে হবে তো ।
--- হুম
বুঝছি । তো প্ল্যান কী তোর!
--- এই যে একটা আবছা আলো তোর মুখ এসে পড়ছে, এই আলোয়
তোর একটা ছবি তুলব ।
মিছরি হাসল । বৃষ্টি
এল আবার । জানলার কাচের ওপাশে ভিজে যাওয়া শহরটা কী অন্যরকম
লাগে । মিছরি আবার ফোনের নিউজ়
অ্যাপ খুলল । দিল্লিতে একের পর এক বাড়ছে মৃতের সংখ্যা । মাঝেমধ্যে
কেমন জানি অবশ লাগে ওর । মনে হয়, এই জীবন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেলে ভাল হত । এই
পৃথিবী ওদের মত মানুষের জন্য নয় । "ফেসবুকে
ভাইরাল ওই ভিডিয়োটা দেখেছিস? ওই যে মানুষের বুকের উপর পা তুলে জাতীয় সঙ্গীত
গাওয়ানো হচ্ছে?", প্রশ্ন করল সৌভিক। মিছরি
মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল। " এইসব
দেখলে এত রাগ হয়, মনে হয় সব তছনছ করে দিই! এই শাসন চাই না! ", সৌভিক
জোরে বলে উঠল ।
মিছরি শান্তভাবে সৌভিকের দিকে তাকাল । বিয়ারের
গ্লাসে চুমুক দিল । " নাইট
অ্যান্ড ফগ" ছবিটার কথা মনে পড়ে?", প্রশ্ন
করল মিছরি ।
--- মনে পড়ে কী, ছবিটা
সঙ্গে নিয়ে বাঁচি ৷ ছবিটা সবসময় অন্যায়ের কথাগুলো মনে করিয়ে দেয় । এই
পৃথিবীতেই সেই সময়, অথচ কত দূরে ।
--- আমি
যেইদিন প্রথম নাইট অ্যান্ড ফগ দেখি, আমি ঘুমাতে পারিনি । কী
অদ্ভুত সময়রেখা । কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের এক একটা অংশ আমরা দেখছি, যা
বর্তমান । ভয়েস ওভারে অতীতের কথা শুনছি । গ্যাস
চেম্বারে মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছি । কত
মানুষ অসহায়ভাবে মারা গিয়েছেন । আর যখন অতীতের ছবি দেখছি, ভয়েস ওভারে তা ঘটমান
বর্তমান হয়ে ওঠে । মনে হয়, সেই অত্যাচারিত মানুষগুলো আমাদের দিকেই
আসছে । আঙুল তুলছে পৃথিবীর দিকে, অন্যায়ের দিকে । কেন
পৃথিবী চুপ করেছিল? কেন রুখে দাঁড়ায়নি?
--- আমার তো সবচেয়ে কষ্ট হয় ওই লোহার তারের
ব্যারিকেডের দৃশ্যটা ভাবলে । শুধু বন্দুক চালানো অভ্যেস করার জন্য মানুষগুলোকে
বলা হত যাও তোমরা চলে যাও...পালিয়ে যাওয়ার সময় পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হত...সেই
লোহার তারের ব্যারিকেডে আটকে থাকত মৃতদেহ । কী
নির্মম! পৃথিবী তো এখনও চুপ করে আছে । পৃথিবী
রুখে দাঁড়াতে জানে না । অসমে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে । অবৈধ
নাগরিকদের সেখানে নিয়ে গিয়ে রাখা হবে বা যারা নাকি ভারতের নাগরিক নয় তারা ডিটেনশন
ক্যাম্পে যাবে! মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ । মানুষ
তাই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে ।
--- ওরা
আসলে ভুলে যায় । রাষ্ট্র কারোর ভার বহন করে না । শ্রমের
এই সিস্টেমে শ্রম দিলে খাবার আসে । কেউ কারোর গ্রাস কেড়ে খায় না । যারা
এক দেশ থেকে সব ছেড়ে চলে এসেছেন, যারা বছরের পর বছর শ্রম
দিয়েছেন । রাষ্ট্র তাদের শ্রম ভোগ করেছে । আজ
তাদের নাগরিকত্বে প্রশ্ন তুলে তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাতে চায় । আমার
এদের উপর করুণা হয় ।
--- কেন তোদের য়ুনিভার্সিটির ওই
ছেলেটার কথাই বল, রুমি নামের ছেলেটা! পুরো নামটা বোধ হয় আজ়িফ রুমি ।
ওকে কী করল? মিডিয়া কীভাবে সাজাল ওর কেসটা? ছিঃ!
মিছরি চমকে গিয়ে সৌভিকের দিকে তাকাল । মাথা
নিচু করে চুপচাপ বসে থাকল । বাইরে
তখনও বৃষ্টি পড়ছে । "কী
হল সুপর্না?" মিছরি নীরব বসে রইল । এই
শহর তবে রুমিকে মনে রেখেছে । আজ তিনবছর পরেও সবাই তবে রুমিকে ভুলে যায়নি । এখনও
মানুষ ভাবছে যে সেদিন অন্যায় হয়েছিল । মিছরির
হাতের উপর হাত রাখল সৌভিক । মিছরি শক্ত করে চেপে ধরল সৌভিকের হাত । ওর
চোখ থেকে জল পড়ছিল । আজ মনে হল, না ওরা ক’জনই
না এখনও শহরের অনেকেই রুমিকে মনে রেখেছে । রুমি
ছাড়া জীবনটা কখনও ভাবতে পারেনি মিছরি । রুমির
হারিয়ে যাওয়ার পর পাশে দাঁড়ায়নি
পরিবার, মিডিয়ার সামনে কথাও
বলতে দেয়নি । তাঁদের কাছে ফিরবে?
বারবার নিজেকে একই প্রশ্ন করেছে এই তিন বছরে । মিছরির মনে হল আর বাঁচবে না । যদিও
ও এখনও বিশ্বাস করে রুমি আবার ফিরে আসবে ।
ক্যাম্পাসে উগ্র দক্ষিণপন্থীরা সংখ্যায় বাড়ছিল । ওদের
বাইরে থেকেও সমর্থন ছিল । মিছরিরা বোঝেনি । রুমি
সবার প্রিয় ছিল । মিছরি কোনওদিন ভাবেনি,
ওর কী ধর্ম । ওরা তো মানবধর্মে বিশ্বাসী ।
শুধু ভালবেসেছিল । রুমিও বোঝেনি ওর শত্রু তৈরি হয়েছিল । সেইদিনও বলেছিল,
ক’দিনের
জন্য বাড়ি ফিরে যাবে । একদিন বিকেলে ক্যাম্পাস
থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে অটোয় উঠল। হাত
নেড়ে বলল, আবার দেখা হবে ! মিছরিও মাথা নাড়ল । পরে
জেনেছিল, হস্টেলে ঝামেলা হয়েছে। ওইদিক
থেকে হুমকি এসেছে । মিছরি কিছু বুঝতে
পারেনি । রুমি এত ভাল ছেলে, ওর শত্রু থাকতে পারে । পরে
বুঝেছে, ধর্ম রুমিকে শত্রু বানিয়েছে । আসলে
ধর্ম না, ওরা রুমিকে রুমির মত অনেককেই শত্রু প্রমাণ করতে চাইছে । মিছরি
কখনও ভাবেনি
আর কোনওদিনও রুমিকে দেখতে পাব না । দুইদির রুমির ফোন বন্ধ । বাড়িও ফেরেনি । হারিয়ে
গিয়েছে রুমি । যোগাযোগ করা যাচ্ছে না । ওরা প্রতিবাদ করেছিল । সোশ্যাল মিডিয়ায়
প্রচার করেছিল । মিছিলে হেঁটেছিল । 12 দিন অনশনের পর অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছিল
। বাড়ি ফেরার পর দেখল সব পাল্টে গিয়েছে । ওরা
কেসটাকে পুরো অন্যভাবে সাজিয়েছে । রুমির
মা থানায় অভিযোগ করতে গেলে ওঁকে মারধর করে বাড়ি পাঠানো হয়েছে
। এফআইআর দায়ের হয়নি । এই ঘটনার কোনও
মিডিয়া কভারেজ হয়নি । উল্টে প্রশাসন দাবি করেছে,
রুমি সমাজবিরোধী কাজে যুক্ত তাই গা ঢাকা দিয়েছে । কাল
নেহা বলেছিল, “একদিন
রুমি ঠিক ফিরবে দেখিস ।”
নিস্তব্ধতা ভাঙল সৌভিক । বলল, “তোর সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগে সুপর্ণা ৷
রাতে তোর মেসেজের অপেক্ষা করি । যেবার সেই ওরিয়েনটেশনে দেখা হল, তখন ভাবিনি যে
আবার তোর সঙ্গে দেখা হবে । তোকে খুব ভাল লেগেছিল । কিন্তু
মনে হত, তুই সেই স্বপ্নটা যাকে ছোঁয়া যায় না । শিলিগুড়ি
থেকে কলকাতা আসার পর তুইই প্রথম মানুষটা যাকে সবচেয়ে ভাল লেগেছিল । আবার
চলে যাবি মিছরি?”
--- তুই
আমার ডাকনাম কীভাবে জানলি?
--- আমি
জানি । বল না, পাশে থাকবি আমার ?
আমি জানি তুই আমার জন্য শহরে এসেছিস । কিন্ত
আমি অন্য একটা কারণে শহরে এসেছি । তোদের সাহায্য প্রয়োজন । থাকবি
আমার পাশে?
--- কী
কারণ? কী সাহায্য শুনি । সেরকম হলে নিশ্চয়ই থাকব ।
--- তোদের য়ুনিভার্সিটির ছেলেটা
রুমি, জানিস নিশ্চয়ই । তোরা একসঙ্গে অনেক কাজ করেছিস । সবাই
জানত, তুই রুমি আরও অনেকেই খুব ভাল বন্ধু ছিলি । মানুষের
পাশে থাকার জন্য রুমি সেসময় বারবার খবরে আসছিল । মাঝেমধ্যে
তুইও আসছিলি । তোর মনে আছ তো রুমির কথা ?
মিছরি অবাক হয়ে সৌভিকের দিকে তাকাল । রুমিকে
ভুলে যাবে ও? ওর জীবন ছিল রুমি । কীভাবে ভুলে যাবে ! সৌভিক আবার বলল, "রুমির
হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া । রাজনৈতিক বিদ্বেষ, ওর মায়ের উপর পুলিশের অত্যাচার
এসব আমরা জানি । মিডিয়ার মিথ্যে প্রচার আমরা ভুলে যাইনি । এই
শহর রুমিকে ভুলে যায়নি । আমরা জানি ও কোনও সমাজবিরোধী কাজে যুক্ত থাকতে
পারে না । আর রুমিরা হারিয়ে যায় না । ঠিক
ফিরে আসে । যা মানুষের সামনে আসেনি, আমি সেই ছবিই মানুষের
সামনে নিয়ে আসতে চাই সুপর্ণা । আমি এই পুরো ঘটনাটার উপর একটা ডকুমেন্টরি ফিল্ম
করতে চাই । রুমির মা, তোদের সবার ইন্টারভিউ আমার প্রয়োজন। "
মিছরি চুপ করে আছে। সৌভিক
আবার প্রশ্ন করল, "বল না পারব না আমি? থাকবি না তুই পাশে? " মিছরি চুপ করে থাকল । ও
কোনওদিন ভাবেনি, রুমির কথা আবার শহর মনে করবে । কখনও
ভাবেনি, মানুষের সামনে সত্যি আবার আসতে পারে । সৌভিক
ঠিক বলেছে, রুমিরা
কখনও হারিয়ে যায় না । ওরা ফিরে আসবেই ।
--- আমার
ফ্লাইটের সময় হয়ে আসছে সৌভিক। বের হই না কি?
--- চলে যাবি? থেকে যা না!
--- বললাম না, এই শহরে বেশিদিন আমি থাকতে পারি
না । আমার দমবন্ধ লাগে । তুই
ছবির কাজ কবে থেকে শুরু করবি ?
--- পরের মাস থেকে । এই
মাসে প্রি-প্রোডাকশনের কিছু কাজ রয়েছে । ফান্ড
জোগাড় করা, স্ক্রিপ্ট লেখা ইত্যাদি কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে । তুই
পাশে না থাকলে এই ছবিটা করার ভরসা পাচ্ছি
না রে!
--- ফান্ডিং-র
ব্যাপারটা তুই দেখ, আমিও দেখছি । বের
হই রে । দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
দুইজন ব্রডওয়ে থেকে বের হল । ক্যাব
বুক করল মিছরি । "আমি
যাই সঙ্গে? ", জিজ্ঞেস করল সৌভিক । মিছরি মাথা নেড়ে না জানাল । ক্যাব
এসে গেল । মিছরি উঠে পড়ল ক্যাবে । হাত
নেড়ে সৌভিককে বাই জানাল । "ফোন
করিস পৌঁছে । আর শোন, আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর হয়েছিস! মিস
করব! দেখা হবে!" গাড়ির কাচ উঠিয়ে দিল মিছরি ।
৫
একদিনের জন্য শহরে আসা । হোয়াটসঅ্যাপ
খুলে নেহাকে মেসেজে লিখল, 'যাই রে। দেখা হবে আবার ।' রুমি বলত,
তুই আমায় ছেড়ে যেতেই পারিস । আমি তোকে ছেড়ে যাব না । তুই
বিদেশে পড়তে যা, শহরে ফিরলে তোকে আমাতেই ফিরতে হবে । সেই
বছর এমএ শেষ করার পর বিদেশে পিএইচডি করার সুযোগটা ছেড়ে দিয়েছিল মিছরি । মনে
হয়েছিল, আর এইসব চায় না । জীবন, পৃথিবী, স্বপ্ন
মুহূর্তের মধ্যে মিথ্যে হয়ে গিয়েছিল । রুমির
স্বপ্ন, ওর স্বপ্ন, ওদের সবার স্বপ্ন ছিল প্রত্যেকটা মানুষ ভালভাবে বাঁচুক, সমান
অধিকারে বাঁচুক । ওদের সেই স্বপ্ন সময়ের সঙ্গেই হারিয়ে গেছে । এখন
তো নিঃশ্বাস নিতেও ভয় হয় । কিন্তু এই ভয় নিয়ে কতদিন আর বেঁচে থাকা যায়? মুখ খুললে
জীবন যেতে পারে, যাবে ! রুমি ফিরে আসবে না, কিন্তু
অন্যান্য রুমিরা সাহসের সঙ্গে বেঁচে থাকবে । হোয়াটসঅ্যাপ
খুলে সৌভিককে মেসেজে লিখল, "থ্যাংক ইউ! আমি সবরকমভাবে তোর পাশে আছি। রুমির
জন্য আমরা লড়ব। আমি পালাব না। পরের মাসে আসছি । ইন্টারভিউ দেব ।"
উত্তর এল, "জানি।" ক্যাব থেকে নেমে এয়ারপোর্টে ডমেস্টিক
এন্ট্রান্সের দিকে এগিয়ে গেল মিছরি । হঠাৎ
মনে হল কেউ ডাকছে । পিছনে ঘুরে তাকাল, রুমি দাঁড়িয়ে! সেইদিন
অটোয় ওঠার সময় যে পাঞ্জাবিটা পরে ছিল, সেই পাঞ্জাবিটাই
পরে রয়েছে । হাত নেড়ে বলল, আবার দেখা হবে...
No comments:
Post a Comment