HAPPY READING...


Monday, 20 April 2020

যারা স্বপ্নমিছিলে হেঁটেছিল


হরে ল্যান্ড করল মিছরির ফ্লাইট । আজ প্রায় তিনবছর পর আবার শহরে ফেরা । ফ্লাইট মোড অফ করতেই হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ এল --- “Reached?” মিছরি উত্তর দিল, “just landed. I’ll call you.” এখনও কুয়াশার ঘুম কাটেনি কলকাতার । এয়ারপোর্টের অধিকাংশই আবছায়ায়বেশ শীত করছে । প্লেন থেকে নেমে লাগেজ বেল্টের কাছে এগিয়ে গেল । ফোনের নিউজ় অ্যাপটা খুলল । উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে দাঙ্গায় এখনও পর্যন্ত মৃত 40 । গত দুরাত এক ফোঁটাও ঘুম আসেনি । যতবার চোখ বন্ধ করেছে , ফিরে এসেছে আগুন । বাড়িগুলো জ্বলছে । সারিসারি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে রাস্তায় । রাতে ঘুম না এলে আগে খুব একা লাগত । এখন ঘুম না এলে হোয়াটস অ্যাপ খুলে মেসেজ টাইপ করে --- জেগে আছিস?” ওইদিক থেকেও উত্তর আসে, ঘুম আসছে না ?”  মিছরি কখনও কারোর উপর নির্ভরশীল হতে চায়নি । তবে ইদানীং ওর মনে হয় কোনওভাবে কি ও নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে । 

পাঁচ বছর আগে কলকাতার এক ফিল্ম স্কুলে অ্যাডমিশনের ওরিয়েনটেশনে আলাপ হয়েছিল সৌভিকের সঙ্গে । ফিল্ম স্কুলের সেইবছরের মেরিট লিস্টে নাম আসেনি মিছরির । সৌভিকের অ্যাডমিশন হয়েছিল । এরপর মিছরি সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করে । একদিন ভোরের ট্রেনে শহর ছাড়ে । নিজের কাছেই প্রমিস করেছিল আর কোনওদিনও শহরে ফিরবে না ও । অথচ, এই কলকাতাই মিছরির বড় প্রিয় । প্রত্যেকটা রাস্তা, প্রত্যেকটা গাছ, ভিড় এসব কিছুই আপন । আর সবথেকে প্রিয় ছিল ওর য়ুনিভার্সিটির ক্যাম্পাস । ক্যাম্পাসের প্রত্যেকটা কৃষ্ণচূড়া গাছ, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির রিডিং রুম । 

লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হল মিছরি । নেহাকে ফোন করল কলার টিউনে বাজছে জন ডেনভারের একটা গান, কান্ট্রি রোড টেক মি হোম...টু দ্য প্লেস আই বিলং ।
--- হ্যাঁ বল সুপর্ণা 
--- নেহা আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরোলাম । কোন বাসে উঠব তোর বাড়ি আসার জন্য ?
--- এসি 37(এ) –এ ওঠ । দেখ এয়ারপোর্টের বাইরেই বাসস্ট্যান্ড । কাউকে জিজ্ঞেস কর ।
--- হ্যাঁ দেখতে পেয়েছি । ঠিক আছে রে, পাটুলিতে নেমে তোকে ফোন করছি ।

ফোন কেটে দিয়ে বাসে উঠল মিছরি । কিছুক্ষণ পর বাস ছাড়ল । তিন বছরে কী পাল্টিয়েছে শহরটায় ? দুইদিনের জন্য শহরে ফেরা, তারপর আবার যন্ত্রের মত জীবনযাপন । এই জীবনটাই কি চেয়েছিল মিছরি নাকি একটা পাখির মত হতে চেয়েছিল । স্বপ্ন দেখতেই ভালবাসত ভীষণ । এখন স্বপ্নগুলোকে চাইলেও ছুঁয়ে দেখতে পারে না । কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে । ঘুম ভাঙল সৌভিকের ফোনে । 

--- হ্যাঁ বল সৌভিক ।
--- কোথায় তুই এখন ।
--- বাসে, এসআরএফটিআই-র সামনে । স্বপ্নের পৃথিবীর গেটের সামনে দিয়ে যাচ্ছি ।
--- তুই এখনও সেসব ভাবিস ?
--- কেন ভাবতে বারণ আছে না কি ?
---- আরে না না । তোর সঙ্গে দেখা হওয়ার অপেক্ষা করছি ।
--- আমার জন্যেও কেউ অপেক্ষা করে তবে । মুম্বই থেকে হঠাৎ শহরে এলি কেন ? এই মাসে ছবির কাজ নেই ?
--- তুই এলি কেন ? বলব বলব ছবির কাজ কী আছে । খুব অপেক্ষা করছি সুপর্ণা ।
--- কথা তো ছিলই দেখা হবে । তাই এলাম । কাল দেখা হবে । আগামীকাল সন্ধেয় ফ্লাইট ।
--- সে কী ? আর থাকবি না ? একদিনের জন্য ?
--- এই শহরে বেশদিন থাকা আমার জন্য ভাল না সৌভিক । তোকে কথা দিয়েছিলাম তাই এলাম । চল রাখি । পাটুলি এসে গিয়েছি ।
--- পাটুলি কেন ? বাড়ি যাবি না ?
--- চল টাটা । 

বাস থেকে নামল মিছরি । নেহার থেকে ঠিকানা জেনে নিয়ে রাস্তা পার হল । নেহার এই নতুন ফ্ল্যাটটা বেশ সুন্দর । দরজা খুলেই মিছরিকে জড়িয়ে ধরল নেহা । মিছরির চোখেও জল এল  । 

 ২
ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ খেল নেহা ওর জন্য পছন্দের পদগুলো রান্না করেছিল । ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, চিঙড়ি মাছ । অনেকদিন পর আজ কেউ যত্ন করে রান্না করেছে ওর জন্য । নেহা ওকে খুব ভালবাসে ৷ পৃথিবীতে মিছরিকে যদি কেউ সবচেয়ে বেশি বুঝে থাকে, সে নেহা মিছরি কিছু না বললেও ওর মন পড়ে ফেলতে পারে ৷ প্রিয় সিনেমা থেকে প্রিয় কবিতা সবেতেই ওদের ভীষণ মিল আর ওরা ভালবাসে স্বাধীনতা,  এক স্বাধীন জীবনযাপন       
দেশে এখন খুব কঠিন এক পরিস্থিতি সেই ডিসেম্বর মাস থেকে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন আসার পরে দেশটা কেমন দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল ওরা তো ওটাই চেয়েছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন যদি করে দেওয়া যায় মিছরি জানে রা প্রশ্ন পছন্দ করে না, রা চায় অনুসরণ মানুষ অন্ধের মত অনুসরণ করবে আর এইদিকে মিছরির মত যারাই প্রশ্ন করতে চাইবে তাদের ডানা ভেঙে ফেলে দেওয়া হবে ৫ জানুয়ারি জেএনইউ ক্যাম্পাসে ঢুকে মেরে গেছে ওরা আর শাহিনবাগ...লড়ছে অস্ত্রের বিরুদ্ধে শান্তি হয়ে লড়ছে অধিকারের জন্য লড়ছে মিছরিরাও পাশে আছে ওদের তবু মিছরির খুব ভয় হয় এখন...মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে যায় সেইদিনটার কথা ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি এখন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সপক্ষ ও বিপক্ষ ওরা লড়ছে মরছে মানুষ মৃতদেহ দেখলে মিছরির কান্না পায় ৷ যুদ্ধ শুনলে মিছরির কান্না পায় কাউকে বলতে পারে না স্মৃতি ওকে প্রতিদিন কাঁদায় এই শহর ওকে প্রতিদিন কাঁদায় মিছরি পালিয়ে বেড়ায়

 ৩
নেহার এই এক কামরার ফ্ল্যাটটা খুব সুন্দর নেহা মনের মত সাজিয়েছে সবথেকে সুন্দর ওর বারান্দাটা আলো জ্বলে ফুলগাছ রাখা মনে হয় রূপকথার কোনও এক পৃষ্ঠা পক্ষীরাজ নেমে আসবে এখনই, স্বপ্নের কাছে নিয়ে যাবে ওদের মনেই হয় না,  দেশের আর এক প্রান্তে মানুষ মানুষকে কাটছে এক উগ্র জাতীয়তাবাদ দেশটাকে একটু একটু করে গ্রাস করছে
ওলড মঙ্ক ওদের দুজনেরই খুব প্রিয় গ্লাসের ওলড মঙ্ক একটু একটু মত্ত করছে সন্ধেটা নেহার প্রিয় সুমন , ঘরে বাজছে তাঁর গান
" সুপর্ণা তুই কি কোনওদিনও বাড়ি ফিরবি না?", জিজ্ঞেস করল নেহা মিছরি মাথা নেড়ে না জানাল
---  কেমন কাটছে নতুন শহরে ? তিনবছরে একবারও আমার কথা ভাবলি না দেখা করতে এলি না । এখন কার একটা প্রেমে পড়ে চলে এলি হুম ?
---  প্রেম ? তুইও তাই বলবি নেহা ? তুই তো জানিস আমি কেন শহর ছেড়ে গিয়েছিলাম । আজ়িফ ছাড়া জীবনটা কখনও ভাবতে পারিনি তোর মনে আছে ও কী সুন্দর ছবি আঁকত
--- মনে আছে আমাদের য়ুনিভার্সিটির জীবনের প্রত্যেকটা সময় মনে আছে তোদের কথা মনে আছে  আমাদের স্বপ্নের কথা এখনও মনে পড়ে       
--- আমার কান্না পায় নেহা মনে হয় বাঁচব না মনে হয় একদিন আবার সব ঠিক হয়ে যাবে তাঁরা সবাই ফিরে আসবে যাঁরা হারিয়ে গিয়েছিল ।
কান্নায় ভেঙে পড়ল মিছরি নেহা ওকে জড়িয়ে ধরল মাথায় হাত বুলিয়ে দিল "এসব আর ভাবিস না সুপর্ণা আমরাও ভাবি না আর ওরা কেসটাকে পুরো অন্যভাবে সাজালো, র মা থানায় অভিযোগ করতে গেলে ওকে মারধর করে বাড়ি পাঠানো হল কোনও মিডিয়া কভারেজ হল না আমাদের বন্ধু! আমরা ভাবতেও পারি না মুক্ত পাখির মত একটা ছেলে সারাদিন তোর সঙ্গে...আর ভাবিস না সুপর্ণা! আমরা আছি একদিন সব ঠিক হবে দেখিস "
চোখের জল মুছে গ্লাসে রাম ঢেলে নিল মিছরি "ওর দোষ কী ছিল জানিস নেহা, ও প্রশ্ন করেছিল! আমার এদের ঘেন্না হয় করুণা হয়",  মিছরি বলল নেহা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল নেহার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল মিছরি
--- আমরাও কি মিছিলে হাঁটিনি নেহা ? আমরাও কি মানুষের জন্য ভাবিনি? আজ দেশটা কেমন দুভাগে ভাগ হয়ে গেল মৃত্যুতে আমার ভয় লাগে ওঁর কথা মনে পড়ে

বৃষ্টি এল হঠাৎ জলের ছাঁট এসে লাগছিল মিছরির চোখেমুখে চোখ বন্ধ করে ও দেখতে পাচ্ছিল ক্যাম্পাসের মাঠ সেদিনই থার্ড সেমেস্টার শেষ হয়েছে রা দুজন বসে আছে সেইদিন আকাশে অনেক তারা একটুও মেঘ নেই । কাল বাড়ি ফিরে যাবে আজ়িফ । মিছরির হাত ধরে বলল, " শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা,  তিন মাস ঘুমিয়ে থাকব!"  মিছরি কে ধাক্কা দিয়ে বলল, এসব বলে নাটক করিস না মিছরির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল বলল, "এই যে এইখানে তো ! কয়েকটা দিন আমার বাড়িতে সময় দেওয়া প্রয়োজন । হস্টেলেও আর ভাল লাগছে না । এখনও রাগ করবি ?  চলে আসব দেখিস দুই সপ্তাহ পরেই ।" মিছরি ওর মাথায় হাত রাখল । ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল, তিন সত্যি ?  খুব বেশিদিন আমি তোকে না দেখে থাকতে পারি না তুই জানিস । তাড়াতাড়ি আসবি কথা দে । তুই ছাড়া ক্যাম্পাস আমি ভাবতেও পারি না । ও মিছরির হাত ধরে বলল, কথা দিলাম বাবা । এবার একটা গান শোনা । মিছরি গাইতে শুরু করল, আভি না যাও ছোড়কার...কে দিল আভি ভরা নেহি... হঠাৎই আজ়িফের হস্টেলের বন্ধুরা এল । ওদের মধ্যে থেকেই একজন বলল, তুই এখানে প্রেম করছিস ? ওইদিকে ওরা তোকে খুঁজছে । হস্টেলে দলিত পরিবারের নতুন যে ছেলেটি এসেছে, ওর থাকা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে । এখনই চল । মিছরির কোল থেকে মাথা তুলে নিল ও । উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল । মিছরির দিকে হাত নেড়ে বলল, আসি এখন । পরে দেখা হবে । তুই সাবধানে চলে যাস । এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে চলে গেল । ঘুরেও তাকাল না । মিছরি জানত, ওর সহপাঠী ওর সংগঠনের এই ছেলেটি ক্যাম্পাসে মিছরির পরিচিতি একটু একটু করে কমিয়ে ফেলছে । কখনও ভাল প্রেমিক হতে পারেনি । তাও ওকেই খুব ভালবাসে মিছরি । সেইদিন ফাঁকা মাঠে একা দাঁড়িয়েছিল । ঝাপসা হয়ে এসেছিল ক্যাম্পাস । চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল । চোখ খুলে বাইরে তাকাল মিছরি তখনও বৃষ্টি পড়ছে । নেহার বারান্দার আলো জ্বলছে নিভছে । মিছরির কান্না এল, এই শহর ওর থেকে নিয়েছে, ফিরিয়ে দেয়নি কিছু
---  নেহা তোর সৌভিককে মনে পড়ে ? শিলিগুড়ির ছেলেটা ফিল্ম স্কুলে আলাপ হয়েছিল ওর সঙ্গেই কাল দেখা করব!
--- হ্যাঁবলেছিলি, মনে পড়ে অল্প বেশ তবে দেখা কর ভাল তো আমরাও চাই এখন খেয়ে নিবি চল... 


চাঁদনি মেট্রোর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মিছরি অল্প বৃষ্টি পড়ছে ও চেষ্টা করছে বৃষ্টির জল এড়িয়ে যেতে সৌভিককে ফোন করছে,  সে ধরছে না একটা ক্যাব সামনে এসে দাঁড়াল সৌভিক নামল মিছরির কাছে এগিয়ে এল বলল, "আরে বলিস না! শেয়ারড ক্যাব তো দেরি হয়ে গেল চল রাস্তা পার হই!" মিছরি তাকিয়ে হাসল দুজনে ব্রডওয়েতে ঢুকল রাস্তার দিকে জানলার পাশে একটা টেবিলে বসল পাঁচ বছর পর ওদের দেখা একটু অপ্রস্তুত বোধ করছিল আইসব্রেক করল সৌভিকই
---  বল সাংবাদিকতা কেমন চলছে?
---  তোর ছবি বানানো কেমন চলছে বল আগে!   
---  ছবি কই বানাচ্ছি,  ডিরেকশন টিমে কাজ করছি আর কী! নিজের পরিচিতি তৈরি করব কীভাবে তাই ভাবছি বিয়ার খাবি?
---  ঠান্ডায়?
--- বল না,  খাবি? সারাক্ষণ রাম খেতে হবে না ঠান্ডা লাগলে ডাক্তার দেখানোর দায়িত্ব আমার
মিছরি হাসল সৌভিক দুটো বিয়ার অর্ডার দিল আর ড্রাই চিলিচিকেন" আমার সাংবাদিকতা ঐ চলছে খবর সম্পাদনা করছি, সেরকম থ্রিল কই ! তুই বল কী বলছিলি !"
--- হ্যাঁ এই ফিল্ডে নিজের পরিচিতি তৈরি করাটা খুব প্রয়োজন ইন্ডাস্ট্রিতে সার্ভাইভ করতে হবে তো
--- হুম বুঝছি তো প্ল্যান কী তোর!
--- এই যে একটা আবছা আলো তোর মুখ এসে পড়ছে, এই আলোয় তোর একটা ছবি তুলব       

মিছরি হাসল বৃষ্টি এল আবার জানলার কাচের ওপাশে ভিজে যাওয়া শহরটা কী অন্যরকম লাগে মিছরি আবার ফোনের নিউজ অ্যাপ খুলল দিল্লিতে একের পর এক বাড়ছে মৃতের সংখ্যা মাঝেমধ্যে কেমন জানি অবশ লাগে ওর মনে হয়, এই জীবন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেলে ভাল হত এই পৃথিবী ওদের মত মানুষের জন্য নয় "ফেসবুকে ভাইরাল ওই ভিডিয়োটা দেখেছিস? ওই যে মানুষের বুকের উপর পা তুলে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানো হচ্ছে?", প্রশ্ন করল সৌভিকমিছরি মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল" এইসব দেখলে এত রাগ হয়, মনে হয় সব তছনছ করে দিই! এই শাসন চাই না! ", সৌভিক জোরে বলে উঠল
মিছরি শান্তভাবে সৌভিকের দিকে তাকাল বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিল " নাইট অ্যান্ড ফগ" ছবিটার কথা মনে পড়ে?", প্রশ্ন করল মিছরি
--- মনে পড়ে কী, ছবিটা সঙ্গে নিয়ে বাঁচি ৷ ছবিটা সবসময় অন্যায়ের কথাগুলো মনে করিয়ে দেয় এই পৃথিবীতেই সেই সময়, অথচ কত দূরে
--- আমি যেইদিন প্রথম নাইট অ্যান্ড ফগ দেখি, আমি ঘুমাতে পারিনি কী অদ্ভুত সময়রেখা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের এক একটা অংশ আমরা দেখছি, যা বর্তমান ভয়েস ওভারে অতীতের কথা শুনছি গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছি কত মানুষ অসহায়ভাবে মারা গিয়েছেন আর যখন অতীতের ছবি দেখছি, ভয়েস ওভারে তা ঘটমান বর্তমান হয়ে ওঠে মনে হয়, সেই অত্যাচারিত মানুষগুলো আমাদের দিকেই আসছে আঙুল তুলছে পৃথিবীর দিকে, অন্যায়ের দিকে কেন পৃথিবী চুপ করেছিল? কেন রুখে দাঁড়ায়নি?
--- আমার তো সবচেয়ে কষ্ট হয় ওই লোহার তারের ব্যারিকেডের দৃশ্যটা ভাবলে শুধু বন্দুক চালানো অভ্যেস করার জন্য মানুষগুলোকে বলা হত যাও তোমরা চলে যাও...পালিয়ে যাওয়ার সময় পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হত...সেই লোহার তারের ব্যারিকেডে আটকে থাকত মৃতদেহ কী নির্মম! পৃথিবী তো এখনও চুপ করে আছে পৃথিবী রুখে দাঁড়াতে জানে না অসমে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে অবৈধ নাগরিকদের সেখানে নিয়ে গিয়ে রাখা হবে বা যারা নাকি ভারতের নাগরিক নয় তারা ডিটেনশন ক্যাম্পে যাবে! মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ মানুষ তাই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে
--- ওরা আসলে ভুলে যায় রাষ্ট্র কারোর ভার বহন করে না শ্রমের এই সিস্টেমে শ্রম দিলে খাবার আসে কেউ কারোর গ্রাস কেড়ে খায় না যারা এক দেশ থেকে সব ছেড়ে চলে এসেছেন, যারা বছরের পর বছর শ্রম দিয়েছেন রাষ্ট্র তাদের শ্রম ভোগ করেছে আজ তাদের নাগরিকত্বে প্রশ্ন তুলে তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাতে চায় আমার এদের উপর করুণা হয়
---  কেন তোদের য়ুনিভার্সিটির ওই ছেলেটার কথাই বল, রুমি নামের ছেলেটা! পুরো নামটা বোধ হয়  আজ়িফ রুমি । ওকে কী করল? মিডিয়া কীভাবে সাজাল ওর কেসটা? ছিঃ!
মিছরি চমকে গিয়ে সৌভিকের দিকে তাকাল মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকল বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে "কী হল সুপর্না?" মিছরি নীরব বসে রইল এই শহর তবে রুমিকে মনে রেখেছে আজ তিনবছর পরেও সবাই তবে রুমিকে ভুলে যায়নি এখনও মানুষ ভাবছে যে সেদিন অন্যায় হয়েছিল মিছরির হাতের উপর হাত রাখল সৌভিক মিছরি শক্ত করে চেপে ধরল সৌভিকের হাত ওর চোখ থেকে জল পড়ছিল আজ মনে হল, না ওরা কজনই না এখনও শহরের অনেকেই রুমিকে মনে রেখেছে রুমি ছাড়া জীবনটা কখনও ভাবতে পারনি মিছরি রুমির হারিয়ে যাওয়ার পর পাশে দাঁড়ায়নি পরিবার, মিডিয়ার সামনে কথা বলতে দেয়নি । তাঁদের কাছে ফিরব? বারবার নিজেকে একই প্রশ্ন করেছে এই তিন বছরে । মিছরির মনে হল আর বাঁচবে না । যদিও ও এখনও বিশ্বাস করে রুমি আবার ফিরে আসবে
ক্যাম্পাসে উগ্র দক্ষিণপন্থীরা সংখ্যায় বাড়ছিল ওদের বাইরে থেকেও সমর্থন ছিল মিছরিরাোঝেনি রুমি সবার প্রিয় ছিল মিছরি কোনওদিন ভাবনি, ওর কী ধর্ম রা তো মানবধর্মে বিশ্বাসী শুধু ভালবেসেছিল রুমিও বোঝেনি ওর শত্রু তৈরি হয়েছিল সেইদিনও বলেছিল, কদিনের জন্য বাড়ি ফিরে যাবে একদিন বিকেলে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে অটোয় উঠলহাত নেড়ে বলল, আবার দেখা হবে ! মিছরিও মাথা নাড়ল পরে জেনেছিল, হস্টেলে ঝামেলা হয়েছেওইদিক থেকে হুমকি এসেছে মিছরি কিছু বুঝতে পারেনি । রুমি এত ভাল ছেলে, ওর শত্রু থাকতে পারে পরে বুঝেছে, ধর্ম রুমিকে শত্রু বানিয়েছে আসলে ধর্ম না, ওরা রুমিকে রুমির মত অনেককেই শত্রু প্রমাণ করতে চাইছে মিছরি কখনও ভাবনি আর কোনওদিনও রুমিকে দেখতে পাব না দুইদির রুমির ফোন বন্ধ । বাড়িও ফেরেনি । হারিয়ে গিয়েছে রুমি । যোগাযোগ করা যাচ্ছে না । ওরা প্রতিবাদ করেছিল । সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করেছিল । মিছিলে হেঁটেছিল । 12 দিন অনশনের পর অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছিল । বাড়ি ফেরার পর দেখল সব পাল্টে গিয়েছে । ওরা কেসটাকে পুরো অন্যভাবে সাজিয়েছে । রুমির মা থানায় অভিযোগ করতে গেলে ওকে মারধর করে বাড়ি পাঠানো হয়েছে এফআইআর দায়ের হয়নি । এই ঘটনার কোনও মিডিয়া কভারেজ হয়নি উল্টে প্রশাসন দাবি করেছে, রুমি সমাজবিরোধী কাজে যুক্ত তাই গা ঢাকা দিয়েছে কাল নেহা বলেছিল, একদিন রুমি ঠিক ফিরবে দেখিস

নিস্তব্ধতা ভাঙল সৌভিক । বলল, তোর সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগে সুপর্ণা ৷ রাতে তোর মেসেজের অপেক্ষা করি যেবার সেই ওরিয়েনটেশনে দেখা হল, তখন ভাবিনি যে আবার তোর সঙ্গে দেখা হবে তোকে খুব ভাল লেগেছিল কিন্তু মনে হত, তুই সেই স্বপ্নটা যাকে ছোঁয়া যায় না শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা আসার পর তুইই প্রথম মানুষটা যাকে সবচেয়ে ভাল লেগেছিল আবার চলে যাবি মিছরি?
---  তুই আমার ডাকনাম কীভাবে জানলি?
---  আমি জানি বল না, পাশে থাকবি আমার ? আমি জানি তুই আমার জন্য শহরে এসেছিস কিন্ত আমি অন্য একটা কারণে শহরে এসেছি তোদের সাহায্য প্রয়োজন থাকবি আমার পাশে?
---  কী কারণ? কী সাহায্য শুনি সেরকম হলে নিশ্চয়ই থাকব
---  তোদের য়ুনিভার্সিটির ছেলেটা রুমি, জানিস নিশ্চয়ই তোরা একসঙ্গে অনেক কাজ করেছিস সবাই জানত, তুই রুমি আরও অনেকেই খুব ভাল বন্ধু ছিলি মানুষের পাশে থাকার জন্য রুমি সেসময় বারবার খবরে আসছিল মাঝেমধ্যে তুইও আসছিলি তোর মনে আছ তো রুমির কথা

মিছরি অবাক হয়ে সৌভিকের দিকে তাকাল রুমিকে ভুলে যাবে ও? ওর জীবন ছিল রুমি কীভাবে ভুলে যাবে !  সৌভিক আবার বলল, "রুমির হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক বিদ্বেষ,  ওর মায়ের উপর পুলিশের অত্যাচার এসব আমরা জানি মিডিয়ার মিথ্যে প্রচার আমরা ভুলে যাইনি এই শহর রুমিকে ভুলে যায়নি আমরা জানি ও কোনও সমাজবিরোধী কাজে যুক্ত থাকতে পারে না আর রুমিরা হারিয়ে যায় না ঠিক ফিরে আসে যা মানুষের সামনে আসেনি, আমি সেই ছবিই মানুষের সামনে নিয়ে আসতে চাই সুপর্ণা আমি এই পুরো ঘটনাটার উপর একটা ডকুমেন্টরি ফিল্ম করতে চাই রুমির মা, তোদের সবার ইন্টারভিউ আমার প্রয়োজন"
মিছরি চুপ করে আছেসৌভিক আবার প্রশ্ন করল, "বল না পারব না আমি? থাকবি না তুই পাশে? "   মিছরি চুপ করে থাকল ও কোনওদিন ভাবেনি, রুমির কথা আবার শহর মনে করবে কখনও ভাবেনি, মানুষের সামনে সত্যি আবার আসতে পারে সৌভিক ঠিক বলেছে,  রুমিরা কখনও হারিয়ে যায় না ওরা ফিরে আসবেই
--- আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে আসছে সৌভিকবের হই না কি?
--- চলে যাবি? থেকে যা না!
--- বললাম না,  এই শহরে বেশিদিন আমি থাকতে পারি না আমার দমবন্ধ লাগে তুই ছবির কাজ কবে থেকে শুরু করবি ?
--- পরের মাস থেকে এই মাসে প্রি-প্রোডাকশনের কিছু কাজ রয়েছে ফান্ড জোগাড় করা, স্ক্রিপ্ট লেখা ইত্যাদি কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে তুই পাশে না থাকলে এই ছবিটা করার ভরসা পাচ্ছি না রে!
---  ফান্ডিং-র ব্যাপারটা তুই দেখ, আমিও দেখছি বের হই রে দেরি হয়ে যাচ্ছে

দুইজন ব্রডওয়ে থেকে বের হল ক্যাব বুক করল মিছরি "আমি যাই সঙ্গে? ", জিজ্ঞেস করল সৌভিক   মিছরি মাথা নেড়ে না জানাল ক্যাব এসে গেল মিছরি উঠে পড়ল ক্যাবে হাত নেড়ে সৌভিককে বাই জানাল "ফোন করিস পৌঁছে আর শোন, আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর হয়েছিস! মিস করব! দেখা হবে!" গাড়ির কাচ উঠিয়ে দিল মিছরি । 
কদিনের জন্য শহরে আসা হোয়াটসঅ্যাপ খুলে নেহাকে মেসেজে লিখল, 'যাই রেদেখা হবে আবার '  রুমি বলত, তুই আমায় ছেড়ে যেতেই পারিস আমি তোকে ছেড়ে যাব না তুই বিদেশে পড়তে যা, শহরে ফিরলে তোকে আমাতেই  ফিরতে হবে সেই বছর এমএ শেষ করার পর বিদেশে পিএইচডি করার সুযোগটা ছেড়ে দিয়েছিল মিছরি মনে হয়েছিল, আর এইসব চায় না জীবন, পৃথিবী, স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে মিথ্যে হয়ে গিয়েছিল রুমির স্বপ্ন, ওর স্বপ্ন, ওদের সবার স্বপ্ন ছিল প্রত্যেকটা মানুষ ভালভাবে বাঁচুক, সমান অধিকারে বাঁচুক ওদের সেই স্বপ্ন সময়ের সঙ্গেই হারিয়ে গেছে এখন তো নিঃশ্বাস নিতেও ভয় হয় কিন্তু এই ভয় নিয়ে কতদিন আর বেঁচে থাকা যায়? মুখ খুললে জীবন যেতে পারে, যাবে !  রুমি ফিরে আসবে না, কিন্তু অন্যান্য রুমিরা সাহসের সঙ্গে বেঁচে থাকবে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে সৌভিককে মেসেজে লিখল, "থ্যাংক ইউ! আমি সবরকমভাবে তোর পাশে আছিরুমির জন্য আমরা লড়বআমি পালাব না পরের মাসে আসছি । ইন্টারভিউ দেব ।" উত্তর এল, "জানি" ক্যাব থেকে নেমে এয়ারপোর্টে ডমেস্টিক এন্ট্রান্সের দিকে এগিয়ে গেল মিছরি হঠাৎ মনে হল কেউ ডাকছে পিছনে ঘুরে তাকাল, রুমি দাঁড়িয়ে! সেইদিন অটোয় ওঠার সময় যে পাঞ্জাবিটা পরে ছিল, সেই পাঞ্জাবিটাই পরে রয়েছে হাত নেড়ে বলল, আবার দেখা হবে...     




                                        
                                  

                             
 

No comments:

Post a Comment