HAPPY READING...


Monday, 19 December 2022

হাওয়া: সমুদ্রের অতল গভীরে উপকথার কাব্যিক দৃশ্যায়ন

 ‘হাওয়া’ (Hawa) দেখার পর থেকে এক ঘোরের মধ্যে রয়েছি। এই ঘোর কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে বেশ কিছুদিন যে সময় লাগবে, তা বুঝতে বাকি নেই। একটি ছবি দেখার পর যদি এই ঘোরটাই না তৈরি হয়, তবে বড় পর্দার সামনে বসে অপলকে তাকিয়ে থাকাই বৃথা। মেজবাউর রহমান সুমনের এই অসাধারণ সৃষ্টিকে বারবার কুর্নিশ জানাতে ইচ্ছে করে। একটা ছবি তৈরি করতে প্রচুর শ্রম এবং গবেষণার প্রয়োজন। নাহলে সেই ছবির প্রতি বা চিত্রনাট্যের প্রতিই অবিচার করা হয়। আর যখন আমরা এই ‘অবিচার’ দেখতে দেখতে ক্লান্ত, তখন এইসব গিমিক, সেই উচ্চ মধ্যবিত্তের বৈঠকখানার ঘুপচি পরিসর এবং গদগদ সংলাপের ভিড়কে পাশে সরিয়ে হাওয়া আমাদের সেই পরিসরে পৌঁছে দেয়, যেখানে মনপ্রাণ ভরে এই সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গুয়েজ বা সিনেমার ভাষাকে উপভোগ করতে পারি। এই পরিসরে জলের অতল গভীরে ক্যামেরাও কাব্যিক হয়ে ওঠে।



ছবির শুরুতেই সমুদ্রের সেই অতল গভীরে নিয়ে চলেন পরিচালক। এখানেই আখ্যানের সূত্রপাত। মাঝ সমুদ্রে জল যেখানে শান্ত, সেখানেই চিত্রনাট্য আরও গভীরে প্রবেশ করে। নোঙরের সঙ্গে ক্যামেরা যখন জলের ভিতর ডুব দেয়, আমরাও এক গভীরতায় প্রবেশ করি। যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় নেই। ছবিতে পরিসর বাঁধা। একটি ট্রলার এবং মাঝ সমুদ্রের পরিসরকে ব্যবহার করেই এক একটি দৃশ্য তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু, প্রতিটি দৃশ্য এত নিখুঁতভাবে তৈরি, তাই কোনওভাবেই এই পরিসরকে একঘেয়ে মনে হয় না। বরং জলের এই শীতল কবিতায় ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে। জোৎস্নায় উড়ন্ত শাড়িও যেন স্তিমিত।




এই পরিসর কি বাস্তব নাকি পরিচালক ইতিমধ্য়েই এক অধিবাস্তব পরিসর তৈরি করেছেন? এখানে যে এই দুইয়ের মাঝের রেখাটি বেশ সূক্ষ্ম এবং মলিন। ছেঁড়া পালের অবশিষ্ট হাওয়ায় উড়তে দেখে মনে হয়, এই অধিবাস্তবতায় রূপকথার ছোঁয়া নেই। এটি একটি ডিসটোপিয়া। যে দরিয়ায় আমরা ডুবছি ও ভাসছি। ক্যামেরার এরকম অসাধারণ কাজ, কম্পোজিশন, অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যবসায় ছাড়া সম্ভব নয়। 


কিছু পরিচিত উপকথার ভিড়ে হাওয়ার এই চিত্রনাট্য হারিয়ে যেতে পারত। কয়েকটি চরিত্র নির্ভর একটা ছবি হয়ে থেকে যেতে পারত। কিন্তু হাওয়া হতাশ করেনি। বরং, দিন-রাতের আসা যাওয়ার মাঝে, হাওয়া এক কাব্যিক উপাখ্যান তৈরি করেছে। যেখানে, বাস্তব এবং অধিবাস্তব মিলেমিশে গিয়েছে। কখনও তা ভালোবাসার রূপকথা আবার কখনও শুধুমাত্র প্রতিশোধের গল্প। অসংখ্য অনুভূতির গহন প্রান্ত। নাটকীয়তাও কখনও তার বাস্তব ছোঁয়া থেকে এক বিন্দু সরে যায়নি। হাওয়ার এক একটি দৃশ্য মাঝেমধ্য়েই ‘লিকুইড পার্সেপশন’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। 



‘চান মাঝির’ ভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরি এবং ছবির অন্যান্য অভিনেতারা যেভাবে নিজেদের ভেঙে-গড়ে সেই চরিত্রে পরিণত করেছেন। তার প্রশংসা করতেই হয়। প্রত্যেকটি চরিত্রে, দৃশ্যে ও সর্বোপরি ছবির আখ্যানে উপকূলীয় ছাপোষা জীবনধারার ছাপ রয়েছে। প্রতিটি ছত্রে টক্সিক পৌরুষকে সমালোচনা করেছে।



খুব সাধারণ একটি গল্প়ও চলচ্চিত্রে মাস্টারপিস হয়ে উঠতে পারে সিনেমার কিছু উপাদানকে ব্যবহার করে। ছবিতে ক্যামেরার ব্যবহার, দৃশ্য সংগঠন এবং অত্যন্ত ভালো চিত্রনাট্য একটি সাধারণ ন্যারেটিভকেও অসাধারণ করে তুলতে পারে। আর সেখানেই লুকিয়ে থাকে পরিচালক ও তাঁর টিমের মুনশিয়ানা। ‘হাওয়া’-এর মতো একটি ছবি তৈরি করার জন্য এতটা শ্রম, ধৈর্য্য এবং অধ্যবসায় প্রয়োজন। সেই উদাহরণ ছত্রে ছত্রে রয়েছে। যা ছবির প্রতি অবিচার করে না। সিনেমার মতো একটি শিল্পমাধ্যমকে প্রতি মুহূর্তে আরও সমৃদ্ধ করে। গত কয়েক বছরে এরকম ছবি বাংলা দেখেনি। তাই সমসাময়িক সময়ে,দুই বাংলাতেই হাওয়া যে নতুন ছবির এক ধারার নীরব সূচনা করেছে, তা নতমস্তকে স্বীকার করতে হয়। এই অসাধারণ ক্রাফটম্যানশিপকে বারবার কুর্নিশ জানাতে ইচ্ছে করে। হাওয়া বাংলা ভাষার ছবি, হাওয়া বাংলার ছবি! সিনেমা দীর্ঘজীবী হোক!


ছবি সৌজন্য- হাওয়া(Hawa)

Friday, 17 September 2021

সম্পর্কের বহমানতায় থমকে যাওয়া কয়েক মুহূর্ত : দোসর

সম্পর্ক প্রবাহমান অথচ ধীর গতি। এক সীমাহীন জলপ্রপাতের মতো। একটি নদী, যার পাড় ধরে আমরা সাত পা হাঁটতে পারি। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বিশাল মহীরুহের নিচে জিরিয়ে নিতে পারি। কিন্তু অন্তমিলে দুই জনের দেখা হয় না। জয় গোস্বামী তাঁর এক কবিতায় লিখেছিলেন, সাত পা হাঁটলেই বন্ধু হওয়া যায়। এক অপরের সঙ্গী হওয়া যায়, সম্পর্কে দোসর হওয়া যায়। আমি সেই সম্পর্কের কথাই আজ লিখছি। 


ঋতুপর্ণ ঘোষের একাধিক ছবি আমার খুব প্রিয়, একাধিক ছবি অপ্রিয়। 'দোসর' অপ্রিয়র তালিকায় পড়ে না। বরং, কাবেরী ও কৌশিকের সম্পর্কের টানাপোড়েনে সাদা কালো এক জীবন প্রবাহকে খুঁজে পাই। যে জীবন শালিকের নয়, যে জীবন আমার। কলেজে পড়তে দোসর ছবিটি প্রথম দেখি। তারপর আবার গতকাল। ঋতুপর্ণর মা ও বাবা দুজনেই মারা যাওয়ার পর তিনি খুব একা হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময় রোববারের সম্পাদকীয়তে যখনই ঋতুপর্ণর ব্যক্তিজীবনের প্রসঙ্গ এসেছে, তখনই এসেছে একাকিত্ব ও এক ধীর গতি জীবন। যে জীবন চলতে চলতে একসময় গিয়ে থমকে গিয়েছে, অন্তমিলে দেখা মিলেছে নদীর। ওঁর ছবিতে একাকিত্বের সেই কবিতা বেশ উপভোগ করা যায়। দেখুন, কী যন্ত্রণাময় কিন্তু কাব্যিক। আহা, যন্ত্রণার এমন শিরোনাম দিলেই হত, নাম হত কবিতা। 


চলচ্চিত্র নিজেই একটি মজার বিষয়। তাকে আলাদা করে বর্ণনা করতে হয় না। চলচ্চিত্রে একাধিক দৃষ্টিকোণ হয়। কখনও দর্শক দেখেন, কখনও দেখে সেই পরিসরের এক একটি চরিত্র। কখনও ক্যামেরা নিজেই একটি দৃষ্টি হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, ক্য়ামেরা আর তখন পরিচালকের অধীনে নয়। ক্যামেরা স্বাধীন। সে নিজের মতো ঘুরে বেড়াতে পারে ছবির পরিসরে। তরল দৃষ্টিকোণ বা লিকুইড পার্সেপশনের উদাহরণে ক্যামেরার এরকম মুভমেন্ট বা গতির কথা উল্লেখ করেছিলেন গিলস দেলেউজ। হয়তো চরিত্ররা নিজের মতো কথা বলছে, তাদের কাজ করছে। কিন্তু ক্যামেরার চরিত্রদের অনুসরণ করার কোনও দায়বদ্ধতা নেই। সে স্বতন্ত্র। সে পরিসরে উপস্থিত কিন্তু দৃশ্যের উপর দায়বদ্ধ নয়। দোসরের বেশ কয়েকটি দৃশ্য় স্বতন্ত্র সেই ক্যামেরার উপস্থিতি মনে করিয়ে দেয়। যখন কৌশিক ও মিতা হোটেলের ঘর ছেড়ে আসার পর হোটেলকর্মীরা ঘরে কাজ করছে। তখন ক্যামেরা মুভমেন্ট ক্যামেরার উপস্থিতি যেন স্পষ্ট করে দেয়। দীর্ঘ কথোপকথনের পর কাবেরী তাঁর মায়ের বাড়ি থেকে ফিরে আসছে। নির্দিষ্ট দৃশ্য়ে ও পরিসরে দুই চরিত্র ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। পরিসরে কোনও চরিত্র নেই। কিন্তু ক্যামেরা তখনও স্থির সেই একই স্থানে। এক শূন্যতা অনুভব করে ও করায়। এটি কার দৃষ্টিকোণ জানা নেই, তবে স্থির নয়, তরল। 

কয়েকটি নির্দিষ্ট পরিসর, কয়েকটি চরিত্র এবং কয়েকজন চরিত্র নিয়ে একটি সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য যে তৈরি করে ফেলা যায়। তা ঋতুপর্ণ বার বার প্রমাণ করেছেন। তাঁর ছবির মূল বৈশিষ্ট্যই ছবির সংলাপ ও দৃশ্য সংগঠন। প্রতিটি দৃশ্য এত নিখুঁত ভাবে তৈরি। বদ্ধ পরিসরও যে সুন্দর দৃশ্য তৈরি করতে পারে,  সংলাপ ও আবহের সাহায্য়ে শব্দ গঠন হতে পারে। তা বোঝার জন্য দোসরের প্রতিটি দৃশ্য়ই যথেষ্ট উদাহরণ। 

স্নানঘরের দৃশ্য়ের আলোচনায় আসি। কাবেরী ততক্ষণে কৌশিকের বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের বিষয়ে জানে। কিন্তু কৌশিক অসুস্থ। সদ্য হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। কৌশিকের মধ্য়েও সম্পর্কটা ঠিক করে নেওয়ার এক তাগিদ রয়েছে। কাবেরীকে ফিরে পাওয়ার তাগিদ রয়েছে। কিন্তু প্রথমেই লিখেছিলাম, সম্পর্ক সীমাহীন জলপ্রপাত। কখনও কখনও ভালোবাসার কথা বোঝানোর জন্য নৈঃশব্দের প্রয়োজন পড়ে। নির্ভরশীলতা বোঝানোর জন্য স্পর্শ প্রয়োজন পড়ে। কৌশিক অসহায়ভাবে স্নানঘরে কাবেরীর হাত চেপে ধরে। মুখে কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। তাঁর যন্ত্রণা, তাঁর অনুতাপ, তাঁর প্রেম স্পর্শের কাছেই নত।


এত নিখুঁত দৃশ্যগঠনের প্রশংসা করতেই হয়। তবে কাবেরীর মধ্য়েও যন্ত্রণা কম নয়। তাই হাত সরিয়ে নেয় সে। হয়তো এখানেই চিত্রনাট্যকারের দক্ষতা ও পরিচালকের মুনশিয়ানা। কৌশিক প্রশ্ন করে, "কিছু জানতে চাও না তুমি?" কাবেরী উত্তর দেয়, "কিছু জানার নেই।"

ছবির গল্প খুবই সাধারণ। বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরিরত কৌশিক (অভিনয়ে - প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে ডায়মন্ডহারবার থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। ঘটনাস্থানেই বান্ধবীর মৃত্যু হয়। কৌশিককে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। সেই সময়ই তাঁর স্বামীর বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের কথা জানতে পারেন। কিন্তু এই সাধারণ গল্পের দৃশ্য়গত উপস্থাপন বিষয়টিকে অন্য় মাত্রা দিতে পারে। একটি আহত সম্পর্ক আবার সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। সুস্থ হওয়ার জার্নিটা দীর্ঘ। এই জার্নিটাই চিত্রনাট্য, দৃশ্য...সিনেমা। 


দোসর অর্থাৎ একে অপরের সঙ্গী, টানাপোড়েনে পাশে থাকা, অসহায়তায় বন্ধু হওয়া। প্রথমেই সম্পর্কের নদীর কথা লিখেছিলাম। সেই নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি আসে। সেই পথচলা হয়তো মনোক্রমিক। যেমন হাসপাতালের কেবিনের বাইরে অপেক্ষারত কাবেরী। ট্রেনের গতি ও আওয়াজে যার ভাবনা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়। আর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয় স্বামীর লাগেজে তাঁর বান্ধবীর স্মৃতিতে। ভালোবাসার খোঁজে পথ হারানো রাজকুমারী বিশাল মহীরুহের নিচে জিরিয়ে নেয়। ক্লান্তির কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিয়েছে রাজপুত্র। একে অপরের ঠোঁটে আশ্রয় হয়ে খুঁজে পেয়েছে নিজেদের, কাবেরী ও কৌশিক; দোসর।


ছবি সৌজন্য -  দোসর

ছবি পরিচালক - ঋতুপর্ণ ঘোষ

Thursday, 10 September 2020

ভারতীয় সালিশি সভায় সুস্বাগত !

 
অবশেষে রিয়া গ্রেপ্তার হলেন । কিন্তু কেন গ্রেপ্তার হলেন ? সুশান্তের খুনের জন্য ?  টাকা তছরূপ  ? তাও না । বয়ফ্রেন্ডের জন্য গাঁজা কিনে রিয়া গ্রেপ্তার হলেন । গাঁজাপাচারকারীদের ধরতে সাধারণত স্থানীয় পুলিশই যথেষ্ট । কিন্তু এইক্ষেত্রে সিবিআই ডেকে, হেনস্থা করে এক বড় কাজ উদ্ধার হল । রিয়া গ্রেপ্তার হলেন ! 59গ্রাম গাঁজা উদ্ধারের জন্য শেষে এনসিবির তলব হল ?  কিন্তু যাই হোক, রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব । কেন ?  তার অনেকগুলোই কারণ আছে । বিহার নির্বাচন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান, করোনা সংক্রমণ, পিতৃতান্ত্রিক শোষণ...এই প্রত্যেকটা ক্ষেত্রের জন্য আজ রিয়া গুরুত্বপূর্ণ !
 

 
 
যেইদিন সুশান্তের মৃতদেহ উদ্ধার হয়, সেইদিন অসম্ভব খারাপ লেগেছিল । তার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই আমার অন্যতম প্রিয় অভিনেতার মৃত্যু হয়েছে । তারপর সুশান্তের মত একটি প্রাণোচ্ছল ছেলে এইভাবে আত্মহত্যা করবে কেউ ভাবিনি ।  আসলে আজ পর্যন্ত যাঁরাই আত্মহত্যা করেছেন, আমরা কেউ ভাবিনি তাঁরা আত্মহত্যা করবেন । মানুষ কেন আত্মহত্যা করেন, কী থেকে মুক্তি পেতে... আমরা জানি না । তবে মনস্তত্ত্বের এক ব্যাখ্যা বলে, তাঁরা মৃত্যু চান না । তাঁরা শুধুই যন্ত্রণার অবসান চান । সুশান্তের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই কি না জানি না । সুশান্ত যে মানসিক অবসাদের রোগী ছিলেন, তিনি চিকিৎসা করাচ্ছিলেন । সেই বিষয়ে একাধিক তথ্য প্রকাশ্য এসেছে । সুশান্তের চিকিৎসক, মনোবিদও জানিয়েছেন । সুশান্ত শেষের দিকে ওষুধ খেতেও চাইতেন না । জানি না, রিয়াকে কতটা পাশে পেয়েছেন তিনি, বা রিয়া কী পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে । এটা তাঁদের ব্যক্তিগত পরিসর । তবে রিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই সুশান্তের মৃত্যু হয় । কেন, কী ভেবে সুশান্ত চূড়ান্ত পদক্ষেপ করলেন আমরা জানি না । কিন্তু আমাদের দেশ কেন মানতে পারেনি সুশান্ত অসুস্থ ছিলেন  ? যদি সুশান্তের অন্য কোনও অসুস্থতা থাকত, অবশ্যই সবাই মেনে নিতেন । কিন্তু ভারত মানসিক অসুস্থতা মেনে নিতে পারে না । মানসিক অবসাদ একজন মানুষকে কীভাবে ক্ষয় করতে পারে, তা জানে না । কিশোর বয়স থেকে শুরু করে, চাকরিহীনতা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, আর্থিক অভাব...সবকিছু নীরবেই মেনে নিতে শিখি আমরা । বেশিরভাগ অভিভাবকই মানতে চান না, তাঁর সন্তান মানসিক অবসাদে ভুগছে । আর এই অসুখের বিজ্ঞানসম্মত কারণ আছে । সুশান্তের পরিবারও হয়তো সেই মধ্যবিত্ত মানসিকতার বাইরে না । সুশান্তের মৃত্যুর পর তাঁর টুইটার প্রোফাইল দেখেছি । ইন্স্ট্যা প্রোফাইল দেখেছি । ওঁ মায়ের কথা লিখেছেন । হয়ত যন্ত্রণা সামান্য হলেও অনুভব করেছি । আবার এও দেখেছি, সুশান্তের প্রিয় ভ্যানগগ । আর ভ্যানগগের মৃত্যু আজও রহস্য । তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন, না কি তাঁকে খুন করা হয়েছিল কেউ জানে না । গতবছর সেই আততায়ী বন্দুকের নিলাম হয় । আর এইভাবেই পৃথিবী এক একটি শিল্পকে নিলামে চড়ায় । ভ্যানগগ তাঁর ভাইকে চিঠিতে লিখেছিলেন, তারাদের দৃশ্য তাঁকে সবসময় টানে । সেই তারাদের কাছে যাওয়ার জন্য মৃত্যুকে নির্বাচন করতে পারি আমরা । ভ্যানগগ জীবনের কিছুটা সময় মেনটাল অ্যাসাইলামে কাটিয়েছেন । তার জানলা দিয়ে দেখা দৃশ্য এঁকেছেন । ভ্যানগগ নিজের কান কেটে ফেলেছিলেন, তারও একাধিক ব্যাখ্যা একাধিক জায়গায় পড়েছি । তবে সবথেকে বেশিবার যে কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল... ভ্যানগগের বন্ধু তাঁকে ছেড়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে আটকানোর জন্য তাঁকে বন্ধুত্বহীনতার যন্ত্রণা বোঝানোর জন্য কান কেটে ফেলেন ভ্যানগগ । সেই ভ্যানগগ, যিনি লিখেছিলেন, দুঃখযাপন(স্যাডনেস উইল লাস্ট ফরএভার)চিরন্তন। কেন লিখেছিলেন, ভ্যানগগ কী ভেবেছিলেন কেউ জানি না । আজ এতগুলো কথা লিখলাম, কারণ ভিনসেন্ট আমার খুব কাছের মানুষ, অথচ তাঁকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না । তাঁর ছবি দেখে বারবার এইটাই মনে হয়েছে, তাড়াহুড়ো করছিলেন তিনি । তুলির টান বুঝিয়ে দিয়েছিল সময় কম । এই পৃথিবীতে সময় কম । সুশান্তেরও হয়ত কাছের মানুষ ছিলেন ভিনসেন্ট । আমাদের ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী, আমরা সেই একইরকম ব্যক্তিত্বের দিকে আকৃষ্ট হই । সুশান্তের ক্ষেত্রেও বিষয়টি হয়ত সেরকম । তিনিও ভেবেছিলেন, দুঃখযাপন চিরন্তন । সুশান্তের মৃত্যুতে মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আরও এক নক্ষত্রপতনের সাক্ষী থাকতে পারত । আমরাও হতবাক ছিলাম । যবনিকা পতনের পর অভিনেতার মঞ্চে ফেরার অপেক্ষা করছিলাম । ভেবেছিলাম শিল্প বেঁচে থাকবে । কিন্তু আবার যবনিকা ওঠে, কিন্তু অভিনেতা মঞ্চে ফেরেন না । বরং ফিরে আসে কদর্য রাজনৈতিক কৌশল । একটি রাজনৈতিক দল কতটা নিচ হলে তারা অভিনেতার মৃত্যুকে নির্বাচনের হাতিয়ার করতে পারে ।
 
অক্টোবরে বিহারের বিধানসভা নির্বাচন । তার আগে সুশান্তের মৃত্যুকেই কাজে লাগায় বিজেপি । যখন সবেই রিয়া প্রেমিকের মৃত্যুর কষ্ট মানিয়ে নিচ্ছেন, সেই সময়ে সুশান্তের পরিবারের তরফে অভিযোগ দায়ের হয় রিয়ার বিরুদ্ধে । তিনি সুশান্তের মৃত্যুর জন্য দায়ি । সুশান্তের টাকা নিয়েছেন, সুশান্তকে তাঁর পরিবার থেকে আলাদা করেছেন । এরকম একাধিক অভিযোগ আসতে থাকে তাঁর বিরুদ্ধে । এই একইসময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় রিপাবলিক টিভি । রিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই তাঁকে এমনভাবে পোর্ট্রে করা হয়, যেন রিয়া সত্যিই দোষী । সেই বাঙালি ডাইনি, যে প্রেমিকের টাকা আত্মস্যাৎ করে তাঁকে খুন করে ।
 
উত্তর ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা, এই ধারনায় যথেষ্ট বিশ্বাস করে । অন্তত তাদের সংবাদমাধ্যমের এই প্রচার মেনে নিতে কোনও সমস্যা হয় না । বরং, তারা এই কথাগুলোই শুনতে ভালবাসেন । তাঁরা সেই সব মেয়েদের পছন্দই করেন না, যাঁরা অন্তত ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে নিজের জীবন খুঁজে নিতে চেয়েছেন । পরিশ্রম করছেন । তাই রিয়ার অসম্মান তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে তাদের কোনও অসুবিধে হয়নি । উলটে ভেবেছেন, বেশ হয়েছে । এমনটাই হওয়া উচিত ছিল । ডাইনি একটা ! কিন্তু কেন ডাইনি ? কারণ পিতৃতন্ত্র কখনও মনেই করেনি, একজন মেয়ে অসাধারণ কিছু করতে পারে । তাই সাধারণের বাইরে গিয়ে কিছু করে দেখালেই ভেবে নেওয়া হয় সে জাদু জানে । অর্থাৎ, তার অসাধারণ কিছু করার ক্ষমতা নেই । তাকে জাদুর সাহায্য নিতে হবে । বা সে হয়তো ডাইনি । ডাইনিবাদের সঙ্গে নিকৃষ্ট জেন্ডার পলিটিক্স অতপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে । উত্তর ভারতীয় জেন্ডার পলিটিক্সকে কাজে লাগিয়ে, পিতৃতান্ত্রিক ভোগ বিলাসিতা, শোষণকে আরও উসকে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে বিষয়টি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে বিজেপি । আর বলিকাঠে তোলা হয় রিয়াকে । পাশাপাশি সব বাঙালি মেয়েদেরও একইভাবে সোশাল মিডিয়ায় ট্রোলিং, স্লাট শেমিং শুরু হয় । একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার থেকে আর কীই বা আশা করা যায় ?
 
শেষ পর্যন্ত রিয়ার বিরুদ্ধে একটিও অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হয় না । তিনি প্রেমিকের টাকা আত্মসাৎ করেননি, প্রেমিককে খুন করেননি । কিন্তু বিহার নির্বাচন সামনেই, তাই রিয়াকে গ্রেপ্তার হতেই হবে । নাহলে এই তিনমাসের সম্পূর্ণ প্রোপাগান্ডা মাঠে মারা যাবে বিজেপির । যেখানে অন্যায় হয়ইনি, সেইক্ষেত্রে কী বিচার হবে ?  বিহার নির্বাচনের জন্য ইতিমধ্যেই পোস্টার ছাপানো হয়েছে, যেখানে সুশান্তের মৃত্যু ইশু বানানো হচ্ছে । জাস্টিস ফর সুশান্ত ! একমাত্র বিজেপির পক্ষেই হয়ত কোনও অভিনেতার মৃত্যুকে হাতিয়ার বানিয়ে এই কদর্য খেলা খেলা সম্ভব !
 
রিয়ার সঙ্গে আজ যা হচ্ছে, তাকে অনেকেই সতী প্রথার সঙ্গে তুলনা করেছেন । আসলে বিষয়টা হচ্ছে শাস্তি । ঘেরাটোপ থেকে বের হওয়া, সংগ্রামরত নারীদের জন্য পিতৃতন্ত্র সবসময়ই তুরুপের তাস সাজিয়ে রাখে । প্রয়োজনে ব্যবহার করে । সেই সময় তার নখ, দাঁত, হিংস্র রূপটা বেরিয়ে আসে । রিয়ার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি । সংবাদমাধ্যমের রিয়ার উপর হামলে পড়া এবং সেইসব ছবিতে কদর্য কমেন্ট বুঝিয়ে দিয়েছে পিতৃতন্ত্রের আসল সুপ্ত বাসনাটি ঠিক কী ! একজন মেয়েকে অকারণ যন্ত্রণা দেওয়া ও তাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা । পৈশাচিক আনন্দ । ঠিক যেমন সতী প্রথাতেও হয়ে থাকত । যাঁরা বেঁচে যেতেন, তাঁদের থেকে যৌনতার অধিকার কেড়ে প্রয়োজন মতো ভোগ করত এই ব্রাহ্মণ সমাজই । তারপর শুধুই সময় বদলেছে, আজ কয়েকটি মুষ্টিমেয় সংবাদমাধ্যম ছাড়া বেশিরভাগ মাধ্যমই তাঁবেদারি করে যাচ্ছে । টিআরপি-র জন্য একের পর এক অন্যায় করে যাচ্ছে । ভাবতে লজ্জা লাগে, হনার্স পড়ার সময় এই বিষয়ে কী পড়েছিলাম ! আর আসল দুনিয়াটা কী ! দেশে এক সালিশি সভা বসেছে । বিচার করছে পিতৃতন্ত্র, জ্বালানি দিচ্ছে মিডিয়া । কার বিচার হচ্ছে ? এক নির্দোষ মেয়ের । যার হেনস্থা প্রত্যেকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে শুধুমাত্র নিজেদের পৈশাচিক তৃপ্তির জন্য !
 
তবে সবাই এক পাক্ষিক হয়ে যায়নি । অনেক বলিউড তারকা থেকে শুরু করে, পরিচালক, লেখক, সাংবাদিক, অধ্যাপক, গবেষক, সমাজকর্মী, নারীবাদীরা রিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছেন । আমাদের মত অনেক সাধারণ মানুষ রিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, যা হচ্ছে তা অন্যায় । সোশাল মিডিয়ায় জাস্টিস ফর রিয়া হ্যাশট্যাগও ট্রেন্ড হয়েছে ।
 
আর বিপরীতে বিজেপির মুখপাত্র হয়ে লড়ে যাচ্ছে কঙ্গনা রনওয়াত । আপাতত তাঁর জনপ্রিয়তার প্রয়োজন । যে দেশে সাংবাদিকদের কোনও নিরাপত্তা নেই, সেদেশে অভিনেত্রীকে ওয়াই পর্যায়ের নিরাপত্তা দেয় কেন্দ্র । কারণ তিনি বিজেপির পক্ষে কথা বলেন, সাম্প্রদায়িক কথা বলেন । মুম্বইকে পাক অধিকৃত কাশ্মীর বলতে তাঁর বিন্দুমাত্র বাধে না । যে অভিনেত্রী স্বপ্নের ওই শহরটাকে ভালই বাসতে পারেননি, তাঁর থেকে এই কথাই কাম্য । গতকাল কঙ্গনার বেআইনি কন্সট্রাকশন ভাঙার জন্য অনেক বিজেপি সমর্থক খুব আঘাত পেয়েছে । যদিও জামিয়া, জেএনএউ-র মতো ভারতের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দক্ষিণপন্থী গুন্ডারা এসে ভাঙচুর করেছে । তখন যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী সবাই চুপ ছিলেন । তা থাকাই স্বাভাবিক, ফ্যাসিবাদী সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কবে ভাল চেয়েছিল ?
 
এই লেখা শেষ করার আগে তাঁদের উদ্দেশে দুইটি কথা লিখব । যাঁরা কঙ্গনার পক্ষে কথা বলছেন, এবং রিয়ার পক্ষে কথা বললে তাকে ফেক ফেমিনিজ়ম বলছেন । কারণ তাঁরা মনে করছেন, রিয়ার পক্ষে কথা বললে কঙ্গনার পক্ষেও কথা বলা উচিত কারণ আমরা নারীবাদী । আমি জানি না, ফেক ফেমিনিজ়ম বলে কোনও বিষয়ের অস্তিত্ব আছে কি না, তবে সিউডো ফেমিনিজ়ম বা ছদ্ম নারীবাদ বলে একটি বিষয় রয়েছে । তাঁরা কি সেই বিষয়ের কথাই বলছেন ?  এই কথা আমি আগেও অনেকবার লিখেছি , আবার লিখছি । পিতৃতন্ত্র অর্থাৎ পুরুষকেন্দ্রিক না । পিতৃতন্ত্র একটি সমাজব্যবস্থা, যার শিকড় অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত । এতটাই মজ্জাগত যে আমরা কখনও অজান্তেই পিতৃতান্ত্রিক হয়ে উঠি । সেই জাল থেকেই বেরিয়ে আসাই মুক্তি । পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে মুক্তি । পুরুষের থেকে মুক্তি না ! এই মুক্তির জন্য এক চিরন্তন আন্দোলনের প্রয়োজন, যা লড়ছেন অনেকেই । আমরাও হয়তো কখনও কখনও । এই পিতৃতন্ত্র কী, তা নিয়ে অনেক বই রয়েছে । পিতৃতন্ত্রের উথ্থান নিয়ে মার্ক্সবাদী ব্যাখাও দিয়েছেন ফ্রেডরিক এঙ্গেলস । কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত সহজ করে কমলা ভাসিন তাঁর হোয়াট ইজ় পেটিয়ার্কি বইতে বুঝিয়েছেন । সময়, পরিসরের সঙ্গে সঙ্গে পিতৃতন্ত্রের শোষণ বদলে যায়, সেই একইসঙ্গে তার প্রতিরোধে তার বিরোধিতায় সেইখানে সেইভাবেই গঠিত হয় নারীবাদী আন্দোলন । সমাজের এক একটি স্তরে সেই আন্দোলনের অর্থ ও উদ্দেশ্য আলাদা । এখন বিষয় কেন রিয়ার পক্ষে কথা বলছি, কেন কঙ্গনার পক্ষে কথা বলছি না । তবে আমি ছদ্ম নারীবাদ পোষণ করছি ?  না ! নারীর হয়ে কথা বলার জন্য নারীবাদ না, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধতার জন্য নারীবাদ । তা নারীর বিরুদ্ধেও হতে পারে, পুরুষের বিরুদ্ধেও । সম অধিকারের বিরুদ্ধে ও পুরুষতন্ত্রের পক্ষে যে কথা বলবে, নারীবাদ তার বিরুদ্ধেই গর্জে উঠবে । কঙ্গনা পিতৃতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেছিলেন, তাই নারীবাদ তাঁর বিরুদ্ধতা অবশ্যই করবে । আসলে কোনটা ছদ্ম নারীবাদ বা তরল নারীবাদ তা চিহ্নিত করার জন্যেও ন্যূনতম জ্ঞানের প্রয়োজন হয় । উইকিপিডিয়া না পড়ে দুইটি বই পড়ার প্রয়োজন হয় । তা না পড়ে যে কোনও কিছুকে তকমা দিয়ে দেওয়া যায় না । কোনও বাদ বা ইজ়ম অত সহজ বিষয় নয়, তা বোঝার জন্য অধ্যাবসায়ের প্রয়োজন । কিন্তু তা দিয়ে তাঁদের কাজ নেই । আপাতত তাঁরা রিয়ার সালিশি সভায় মজুক । তাড়িয়ে তাড়িয়ে শাস্তি উপভোগ করুক, কে জানে কাল কী অপেক্ষা করছে...

Wednesday, 19 August 2020

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রতই না হয়, সেই শিক্ষাই অসম্পূর্ণ

এই সময় বিশ্বভারতীকে বাঁচানোর, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বাঁচানোর 

শাসকপক্ষ বারবার বলে, শিক্ষাক্ষেত্র রাজনীতির পরিসর নয় । তবে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার জাগরণ কোথায় হবে ?  একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রমনের যদি রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রতই না হয়, তবে সেই শিক্ষাই অসম্পূর্ণ । বিশ্বে অরাজনৈতিক কোনও ধারনার অস্তিত্ব নেই । একটি ছাত্রমনই প্রশ্ন করবে, অধিকারের জন্য লড়বে । নিজের মৌলিক অধিকার ও দায়িত্ব বুঝে আরও চার-পাঁচজনের কথা ভাববে । দারিদ্র, অন্যায়, অনাহার যদি তাকে না ভাবায় তাহলে সে কি আদৌতে শিক্ষার আলোকে আলোকিত হয়েছে ?  কিন্তু ফ্যাসিবাদী সরকার কখনওই চাইবে না, তাদের কাজের বিরুদ্ধে কেউ প্রশ্ন করুক । তারা কখনওই চাইবে না, শিক্ষার্থীরা মৌলিক অধিকার বুঝে নিক । মানুষের কথা ভাবুক, মানুষের জন্য লড়ুক । বিজেপি সরকারের যে কোনও সিদ্ধান্তের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত সরব হয়েছে । সবথেকে বেশি সরব হতে দেখা গিয়েছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেই । নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হওয়ার পর জামিয়া, জেএনইউ, যাদবপুর, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন । আওয়াজ তুলেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে । এসেছে কবিতা, গান, স্লোগান । শাসকগোষ্ঠী ফিরিয়ে দিয়েছে বুলেট, লাঠি ও অত্যাচার । কিন্তু সেই আন্দোলন থেমে যায়নি । একইভাবে শাহিনবাগ আন্দোলনে ও দিল্লি দাঙ্গার সময়েও ছাত্র-ছাত্রীদের সরব হতে দেখা গিয়েছে । দেখা গিয়েছে দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতিবাদের সুর সবথেকে জোরালো । কারণ, শিক্ষার আলো সেইসব ছাত্রমনকে ছুঁয়েছে । মানুষের কথা ভাবতে শিখিয়েছে, মানুষের পাশে দাঁড়াতে শিখিয়েছে । রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার স্পর্ধা দিয়েছে । এই স্পর্ধা জন্ম জন্মান্তরের, প্রকৃত শিক্ষা সঠিক রাস্তা চিনিয়ে দেয় কেবল...                                    

                        


 শিক্ষাক্ষেত্রের উপরেই বারবার আঘাত কেন ? যাদবপুর, জেএনইউ এখন বিশ্বভারতী ! বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই আঘাত কেন ?  গতবছর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে যেইদিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চার নম্বর গেটে আটকানো হয়, গায়ের জোর দেখিয়ে তিনি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন । তাঁর নিরাপত্তারক্ষীরা ছাত্রীদের গায়ে হাত তোলে । রাতে এবিভিপির গুণ্ডারা এসে ক্যাম্পাসে আগুন লাগায়, ভাঙচুর চালায় । চার নম্বর গেটের বাইরে দোকান ভেঙে দেয় । বন্দুক নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায় । পুলিশ ছাত্রীদের অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে, গায়ে হাত তোলে ! যদিও সংবাদমাধ্যমগুলি নিরপেক্ষ সংবাদ প্রকাশ করেনি । এক পাক্ষিক একটি সংবাদ পরিবেশন করেছিল কেবল । মুষ্টিমেয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যম বাদ দিয়ে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমগুলি ইতিমধ্যেই শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে । সেই দেশে গণতন্ত্রের কথা চিন্তাও করি কীভাবে আমরা ?  বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাঙচুর ও শিক্ষার্থীদের উপর এবিভিপির অকথ্য অত্যাচারের কথা মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলিতে প্রকাশ্যে আসেনি । 

 


চলতি বছরে 5 জানুয়ারি একইভাবে জেএনইউ ক্যাম্পাসে ঢুকে ঐশীকে মারে এবিভিপির গুণ্ডারা । অন্যান্য পড়ুয়া ও অধ্যাপকদেরও মারধর করা হয় । ক্যাম্পাসে ভাঙচুর চলে । জামিয়ার মিছিলে ছাত্রকে গুলি করে এক দুষ্কৃতী । সেইসময়ও পুলিশ ঘটনাস্থানে ছিল ও দাঁড়িয়ে দেখছিল । আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, দিল্লির পুলিশ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে ।

 

                       

 

প্রত্যেকটা ঘটনা থেকে এই বিষয় পরিষ্কার যে, বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকেই লক্ষ্য করেছে দক্ষিণপন্থীরা । রাষ্ট্র ছাত্র-ছাত্রীদের কণ্ঠরোধ করার জন্য চূড়ান্ত পদক্ষেপ করেছে বারবার । কিন্তু কেন ? আমরা ভেবে দেখেছি ?

 

প্যানডেমিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সিবিএসই-র পাঠ্যক্রম থেকে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মতো বিষয়কে বাদ দিয়েছে কেন্দ্র । নতুন শিক্ষানীতি আরোপ করেছে । পুরাতন শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে দিতে চেয়েছে । দেশে এক নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে চেয়েছে , কেন?  কারণ আমরা ভেবে দেখিনি । তবে যদি এখনও ভেবে না দেখি, তবে আর কবে ভাবব ? কারণ এইবার আঘাত এসেছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ।  সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন চলছিলই, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরকে নিয়ন্ত্রণাধীন করতে চাইছে বিজেপি সরকার । আমরা রবীন্দ্রনাথের ভাবধারায় নিজেদের ভাসিয়ে দিতে পারিনি বলেই জ্ঞানের সেই আলোক আমাদের এখনও ছুঁয়ে যেতে পারেনি । পূজা পর্যায়-প্রেম পর্যায়ের মধ্যবর্তী বিভাজন রেখা আমাদের মনে বিলীন হয়ে যায়নি । প্রেমে ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে পারিনি তাই ! সাধারণত হিন্দুত্ববাদীরা পশ্চিমী শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিরোধী হয় । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন গড়ে তোলা, ছাত্র-ছাত্রীদের মুক্ত পরিসরে শিক্ষা দেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল বিদেশের ও দেশের শিক্ষার এক মিলন । খোলা আকাশের নিচে বদ্ধ পরিসরের বাইরে অধ্যাবসায়ের লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল শান্তিনিকেতনের পথ চলা । আমরা বাংলা সাহিত্যে এমনকী বিদেশী সাহিত্যেও তার উল্লেখ পেয়েছি । রবি ঠাকুরের লেখায় তার উল্লেখ পেয়েছি । সেই শান্তিনিকেতন সেই বিশ্বভারতীকে অধীনস্থ করার চেষ্টা চলছে । পৌষমেলার মাঠে পাঁচিল দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে । ছাত্র-ছাত্রীরা বারবার তার বিরোধিতা করেছেন । আওয়াজ তুলেছেন, শান্তিনিকেতন বাঁচাও । এখন সত্যিই আমাদের শান্তিনিকেতন বাঁচানোর সময় ! শান্তিনিকেতনের কোনও বাঁধা পরিসর নেই, থাকতে পারে না । শাসকগোষ্ঠী বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি , বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার আছে পাঁচিল দেওয়ার ! রাজ্যপাল রবি ঠাকুরের উপমা টানছেন । রবি ঠাকুরের স্বপ্নকে আঘাত করে তাঁর কথাই উল্লেখ করার স্পর্ধা কীভাবে হয় এঁদের আমি জানি না । 

 

                 

স্থানীয় লোকজন ও রাজ্যের শাসকদলের কয়েকজনের নামও পাঁচিল ভাঙার ঘটনায় জড়িয়েছে । বিশ্বভারতীর ঘটনাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে বিজেপি । যারা মানুষ বলতে ধর্ম বোঝে, বিভেদ বোঝে, হিংসা বোঝে...তারা শান্তিনিকেতনের পরিবেশ উপলব্ধি করবে কীভাবে ?  রবীন্দ্রনাথের বোলপুর-শান্তিনিকেতনের লালমাটি যারা ছুঁইয়েই দেখেনি তারা কী বুঝবে আদিবাসী গান ! তারা কীভাবে চিনে নেবে খোয়াইয়ের পথ ! বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি নষ্ট করাতে যদি রাজ্যপাল এতই উদ্বিগ্ন হন তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তছনছ করার সময় তিনি চুপ করেছিলেন কেন ?  এখন সত্যিই শান্তিনিকেতন বাঁচানোর সময়, বিশ্বভারতী বাঁচানোর সময় । মানব বন্ধন হয়ে ক্যাম্পাস আগলে রাখতে হবে আমাদেরই । ওরা আসবে, ওরা মারবে । কিন্তু আমাদের মানব বন্ধন ভাঙলে চলবে না । কারণ এই শান্তিনিকেতন আমাদের, বিশ্বের । এক স্বাধীনতার স্বপ্ন, মুক্তির স্বপ্ন, মুক্ত শিক্ষার স্বপ্ন । ওই দাঙ্গাবাজদের নয় । নিজেদের জীবনকে ওরা রবীন্দ্রনাথ দিয়ে বেষ্টিত করতে পারেনি, তাই শিক্ষাপরিসরকে ঘিরে ফেলতে চাইছে !

 

বিশ্বভারতী, যাদবপুর, জেএনইউ এক একটা উদাহরণ মাত্র । আসলে দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই কবজায় করতে চায় ওরা । কারণ শুধু এই প্রজন্ম নয়, আগামী প্রজন্মকেও পঙ্গু করে দিতে চায় । ফ্যাসিবাদী সরকার প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থাকে লক্ষ্য করবে, কারণ সেইখানেই তৈরি হয় বিরোধী মন । ছাত্র-ছাত্রীদের রাষ্ট্রের সামনে দেশদ্রোহী প্রমাণ করতে চাইবে কারণ তাঁরাই প্রশ্ন করার স্পর্ধা দেখায় । যার উত্তর দেওয়ার হিম্মত শাসকপক্ষের নেই । ওরা কী চায় ?  একটা পঙ্গু সমাজ ব্যবস্থা, যারা প্রশ্ন করতে জানে না । যারা অনুসরণ করে । এই সময় বিশ্বভারতীকে বাঁচানোর, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বাঁচানোর । এক ব্যারিকেড যা ঘিরে থাকুক শিক্ষাব্যবস্থা-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান । অন্তত শাসকগোষ্ঠী যেন সেই পরিসরে আঘাত না করতে পারে, ভাঙতে না পারে সেই ব্যারিকেড । রক্ত দিয়ে তৈরি ব্যারিকেড, স্পর্ধা ও শিক্ষার আলোকে তৈরি ব্যারিকেড...জীবন থাকতে যেন সেই ব্যারিকেড ভেঙে না পড়ে...