HAPPY READING...


Monday, 19 December 2022

হাওয়া: সমুদ্রের অতল গভীরে উপকথার কাব্যিক দৃশ্যায়ন

 ‘হাওয়া’ (Hawa) দেখার পর থেকে এক ঘোরের মধ্যে রয়েছি। এই ঘোর কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে বেশ কিছুদিন যে সময় লাগবে, তা বুঝতে বাকি নেই। একটি ছবি দেখার পর যদি এই ঘোরটাই না তৈরি হয়, তবে বড় পর্দার সামনে বসে অপলকে তাকিয়ে থাকাই বৃথা। মেজবাউর রহমান সুমনের এই অসাধারণ সৃষ্টিকে বারবার কুর্নিশ জানাতে ইচ্ছে করে। একটা ছবি তৈরি করতে প্রচুর শ্রম এবং গবেষণার প্রয়োজন। নাহলে সেই ছবির প্রতি বা চিত্রনাট্যের প্রতিই অবিচার করা হয়। আর যখন আমরা এই ‘অবিচার’ দেখতে দেখতে ক্লান্ত, তখন এইসব গিমিক, সেই উচ্চ মধ্যবিত্তের বৈঠকখানার ঘুপচি পরিসর এবং গদগদ সংলাপের ভিড়কে পাশে সরিয়ে হাওয়া আমাদের সেই পরিসরে পৌঁছে দেয়, যেখানে মনপ্রাণ ভরে এই সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গুয়েজ বা সিনেমার ভাষাকে উপভোগ করতে পারি। এই পরিসরে জলের অতল গভীরে ক্যামেরাও কাব্যিক হয়ে ওঠে।



ছবির শুরুতেই সমুদ্রের সেই অতল গভীরে নিয়ে চলেন পরিচালক। এখানেই আখ্যানের সূত্রপাত। মাঝ সমুদ্রে জল যেখানে শান্ত, সেখানেই চিত্রনাট্য আরও গভীরে প্রবেশ করে। নোঙরের সঙ্গে ক্যামেরা যখন জলের ভিতর ডুব দেয়, আমরাও এক গভীরতায় প্রবেশ করি। যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় নেই। ছবিতে পরিসর বাঁধা। একটি ট্রলার এবং মাঝ সমুদ্রের পরিসরকে ব্যবহার করেই এক একটি দৃশ্য তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু, প্রতিটি দৃশ্য এত নিখুঁতভাবে তৈরি, তাই কোনওভাবেই এই পরিসরকে একঘেয়ে মনে হয় না। বরং জলের এই শীতল কবিতায় ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে। জোৎস্নায় উড়ন্ত শাড়িও যেন স্তিমিত।




এই পরিসর কি বাস্তব নাকি পরিচালক ইতিমধ্য়েই এক অধিবাস্তব পরিসর তৈরি করেছেন? এখানে যে এই দুইয়ের মাঝের রেখাটি বেশ সূক্ষ্ম এবং মলিন। ছেঁড়া পালের অবশিষ্ট হাওয়ায় উড়তে দেখে মনে হয়, এই অধিবাস্তবতায় রূপকথার ছোঁয়া নেই। এটি একটি ডিসটোপিয়া। যে দরিয়ায় আমরা ডুবছি ও ভাসছি। ক্যামেরার এরকম অসাধারণ কাজ, কম্পোজিশন, অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যবসায় ছাড়া সম্ভব নয়। 


কিছু পরিচিত উপকথার ভিড়ে হাওয়ার এই চিত্রনাট্য হারিয়ে যেতে পারত। কয়েকটি চরিত্র নির্ভর একটা ছবি হয়ে থেকে যেতে পারত। কিন্তু হাওয়া হতাশ করেনি। বরং, দিন-রাতের আসা যাওয়ার মাঝে, হাওয়া এক কাব্যিক উপাখ্যান তৈরি করেছে। যেখানে, বাস্তব এবং অধিবাস্তব মিলেমিশে গিয়েছে। কখনও তা ভালোবাসার রূপকথা আবার কখনও শুধুমাত্র প্রতিশোধের গল্প। অসংখ্য অনুভূতির গহন প্রান্ত। নাটকীয়তাও কখনও তার বাস্তব ছোঁয়া থেকে এক বিন্দু সরে যায়নি। হাওয়ার এক একটি দৃশ্য মাঝেমধ্য়েই ‘লিকুইড পার্সেপশন’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। 



‘চান মাঝির’ ভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরি এবং ছবির অন্যান্য অভিনেতারা যেভাবে নিজেদের ভেঙে-গড়ে সেই চরিত্রে পরিণত করেছেন। তার প্রশংসা করতেই হয়। প্রত্যেকটি চরিত্রে, দৃশ্যে ও সর্বোপরি ছবির আখ্যানে উপকূলীয় ছাপোষা জীবনধারার ছাপ রয়েছে। প্রতিটি ছত্রে টক্সিক পৌরুষকে সমালোচনা করেছে।



খুব সাধারণ একটি গল্প়ও চলচ্চিত্রে মাস্টারপিস হয়ে উঠতে পারে সিনেমার কিছু উপাদানকে ব্যবহার করে। ছবিতে ক্যামেরার ব্যবহার, দৃশ্য সংগঠন এবং অত্যন্ত ভালো চিত্রনাট্য একটি সাধারণ ন্যারেটিভকেও অসাধারণ করে তুলতে পারে। আর সেখানেই লুকিয়ে থাকে পরিচালক ও তাঁর টিমের মুনশিয়ানা। ‘হাওয়া’-এর মতো একটি ছবি তৈরি করার জন্য এতটা শ্রম, ধৈর্য্য এবং অধ্যবসায় প্রয়োজন। সেই উদাহরণ ছত্রে ছত্রে রয়েছে। যা ছবির প্রতি অবিচার করে না। সিনেমার মতো একটি শিল্পমাধ্যমকে প্রতি মুহূর্তে আরও সমৃদ্ধ করে। গত কয়েক বছরে এরকম ছবি বাংলা দেখেনি। তাই সমসাময়িক সময়ে,দুই বাংলাতেই হাওয়া যে নতুন ছবির এক ধারার নীরব সূচনা করেছে, তা নতমস্তকে স্বীকার করতে হয়। এই অসাধারণ ক্রাফটম্যানশিপকে বারবার কুর্নিশ জানাতে ইচ্ছে করে। হাওয়া বাংলা ভাষার ছবি, হাওয়া বাংলার ছবি! সিনেমা দীর্ঘজীবী হোক!


ছবি সৌজন্য- হাওয়া(Hawa)