HAPPY READING...


Saturday, 23 May 2020

একটি ন্যূনতম ক্ষতি আখ্যান

আমফানের ল্যান্ডফল হওয়ার আগেরদিন সুন্দরবনের একটা খবর সম্পাদনা করেছিলাম। সংবাদের মূল লক্ষ্য ছিল, সিঁদুরে মেঘ দেখছে সুন্দরবন। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে প্রতিমুহূর্তে অস্ত্বিত্বের জন্য লড়ছে। ঘোড়ামারাসহ সুন্দরবনে একাধিক দ্বীপ আছে যারা অস্তিত্ব সংকটে। একটুকু আঁকড়ে লড়ে যাচ্ছে নদীর পারের বসতিগুলো। আমফান আসার পর কী হয়েছে ভাবতে পারি না, যারা ইন্টারভিউতে কথা বলেছিল...যারা বলেছিল, "গরিব তাই জীবনের নিশ্চয়তা নেই!"... সেই মানুষগুলো এখন কোথায়? জানি না ৷ আমফানের আগের বাংলা এবং আমফান পরবর্তী বাংলা এক নয় ৷ বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গ। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনা...হয়তো প্রায় ধ্বংসাবশেষ সুন্দরবন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, যেকোনও সংবাদমাধ্যমের কাছে সেই ধ্বংস, সেই যন্ত্রণা, সেই সর্বহারাদের গল্প গুরুত্ব পায় না। যতটা কলকাতা পায়।




আমরা দক্ষিণের শহরতলি৷ গতকাল বাইরে বেরিয়েছিলাম। দেখলাম ভেঙেচুরে পড়ে আছে আমার এই ছোটো শহরটা। কতক্ষণ বিদ্যুৎ পরিষেবা নেই, কতক্ষণ কাছের মানুষগুলোকে যোগাযোগ করতে পারিনি আর হিসেব থাকছিল না। এক একটা টিউবওয়েলে বড় লাইন। কারণ পানীয়জল নেই আমাদের। তখন কোথায় সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং কোথায় কী? ইতিমধ্যেই বাঁচার লড়াই শুরু হয়েছে। তখন ইত্যাদি অসুখ মাথায় আসে না...খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের বাইরে আসলে মানবসভ্যতা কিছু চায়নি। বাকি যা কিছু একটা মরীচিকার মত। গতকাল প্রায় ৬০ ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ সংযোগ আংশিকভাবে ফিরেছে। এখনও মোবাইল ইন্টারনেট কোনওভাবে চলছে। অন্তত দুইদিনে একথা স্পষ্ট...সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিস্থিতি নিয়ে লিখতে গেলেও বা দুটি ছবি শেয়ার করার জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা প্রয়োজন। আসলে যারা পোস্ট করতে পারেনি বা পারছে না যাদের যোগাযোগ করা যায়নি এখনও তাদের কী পরিস্থিতি কিছু জানি না।

আমার শহরতলির এরকম অসহায় মুখ আমায় কখনও দেখতে হবে ভাবিনি। আমি এও ভাবিনি আমার জেলা এইভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। আমি কখনও ভাবিনি আমার য়ুনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের লাল কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো উপড়ে যাবে কিংবা ভেঙে যাবে লাইব্রেরির সামনের স্কাল্পচার। আমি ভাবিনি কলেজ স্ট্রিটের বইগুলো ডুবে যাবে এভাবেই। আমি কল্পনা করতে পারিনি কুমোরটুলির এখন অবস্থা কী? আমি জানি না আমার সেই বন্ধুরা কেমন আছে যাদের এখনও যোগাযোগ করতে পারিনি...



আমার এক বন্ধু আমায় গতকাল মেসেজে লিখে পাঠিয়েছিল,ওদের হাউসিং-এর সামনে একটা হলুদ রাধাচূড়া গাছ ছিল। হলুদ ফুলে বিছিয়ে থাকত চারধার। এখন সেখানে হলুদ রাধাচূড়ার মৃতদেহটাই আছে। আমিও কখনও ভাবিনি, ছোটো থেকে যে গাছটা দেখতে দেখতে বড় হয়েছি সেই গাছটাই ওভাবে ভেঙেচুরে রাস্তায় পড়ে থাকবে। যে রাস্তায় ছুটে ছুটে খেলে বেরিয়েছি সেই রাস্তার অংশ ভেঙে পড়ে থাকবে। আমি ভাবিনি। আমরা গাছেদের ভালবেসেছি, আমরা কলেজ স্ট্রিট ভালবেসেছি, বইয়ের গন্ধ ভালবেসেছি। আমরা ভালবেসেছি ক্যাম্পাস, শহরের প্রত্যেকটা গলি আর প্রত্যেকটা মানুষকে। না দেখা সুন্দরবনকেও ভালবেসেছি। তাই তো এত যন্ত্রণা হচ্ছে । কষ্ট হচ্ছে আমার বাংলার জন্য । পরিস্থিতি একটু সামলে নিয়ে 'পারেঞ্জার্স'-র পক্ষ থেকে খুব দ্রুত কাজ শুরু হবে। কারণ, আমরা প্রত্যেকে পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত।

আমার কেরলের সহকর্মী আমায় অনেকবার ফোন করেছে। মেসেজ এসেছে বিদেশের বন্ধুর থেকেও...জানতে চেয়ে আমরা কেমন আছি? বাংলা কেমন আছে? আবার অনেকেই বাঙালির উপর ঘেন্না থেকে পরিস্থিতিতে হেসেছে ৷

ফেসবুকে আমার বন্ধুরা অনেকেই শেয়ার করেছেন দেখলাম কয়েকটি স্ক্রিনশট। যেখানেই এই বিষয়টি দেখা গিয়েছে যে নির্দিষ্ট এক বলয়ের লোকজন বেশ খুশি। পশ্চিমবাংলার এই পরিণতিতে তারা বেশ খুশি। কেউ মনে করেন এটা শিবের রাগ, কেউ মনে করেন বাংলার পাপের কারণ। কেউ বলেছেন, "ন্যূনতম ক্ষতি!" এদের চিনে রাখা উচিত কি না জানি না, এদের মানুষ বলে মনে করি না। আর অমানুষ দেখতে মানুষের মতই। আমাদের অবাক লাগে কেন জানেন, কারণ বাংলার মানুষ এমনভাবে ভাবতে শেখেনি। বাংলা জানে, অন্যের জন্য লড়াই করতে...বাঙালি জানে অন্যের জন্য গর্জে উঠতে। কেরলের বন্যায় ত্রাণ পৌঁছে দিতে দুবার ভাবে না। কিংবা উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সংঘর্ষের সময় কলকাতার কয়েকজন ছেলেমেয়ে গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল যখন? অন্য রাজ্যের কষ্টে চোখের জল ফেলেছিল বাঙালি। ভারতের যে নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্র অন্যায় করবে ভেবেছিল, তাদের হয়ে আওয়াজ উঠিয়েছিল বাঙালি। একসঙ্গে বলে উঠেছিল, "আমরা কাগজ দেখাব না!" এগুলো আমাদের শিখিয়ে দিতে হয়নি কোনওদিন। এগুলো আমরা এমনিই জানি। তাই অন্যের যন্ত্রণায় কোনওদিন হাসতে পারব না। অশিক্ষিতর মতো বলে দিতে পারব না, মিডিয়া কভারেজ পায়নি তাই এত চিৎকার করছে দেখে হাসি পাচ্ছে। উল্টে সেই রাজ্যটাই যদি কোনও ঘটনায় মিডিয়া কভারেজ না পায় আমরা প্রতিবাদের সুর তুলবই। আমাদের রক্তে বিপ্লব আছে, তা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন জানে। ৭০-এর বাংলাদেশ জানে, ভারতও জানে। তাই আমরা ঠিক উঠে দাঁড়াবই...হয়তো আজ না কিন্তু কয়েকদিন পরেই। সুন্দরবনের মানুষ হাসবে। কাকদ্বীপ, সাগরদ্বীপ আবার গড়ে নেবে নিজেকে। অসুখ ক্লান্ত জেলাগুলো ঠিক উঠে দাঁড়াবে ৷ আমার শহরতলির অসুখ ঠিক হবে। আবার ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল ফুটবে । বন্ধুর হাউসিংয়ের সামনে রাধাচূড়ার মৃতদেহ থেকেই জন্ম নেবে নতুন প্রাণ। কলেজস্ট্রিটের দোকানগুলোয় ভিড় হবে আবার। ধ্বংসস্তূপ থেকেই জেগে উঠবে বাংলা। হাসবে, আর হ্যাঁ এও জেনে রাখুন আপনার বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। আমরা উঠে দাঁড়াতে জানি কারণ আমাদের মেরুদণ্ডটা গুঁড়িয়ে যায়নি যেমন সেই 'তাদের' অনেকদিন আগেই গেছে...




ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া। আমায় ক্ষমা করবেন, জানি না এই ছবি কার বা কাদের তোলা তাই ক্রেডিট দিতে পারলাম না।