HAPPY READING...


Friday, 15 December 2017

আমি, বিচ্ছেদ এবং কোমল গান্ধার

 “আপনি জানেন ওপারে না পূর্ব বাংলা, এটা পদ্মা; আমি আগে জানতাম না! ওপারেই কোথাও আমার দেশের বাড়ি, এখানকার আকাশটা ধোঁয়া না!” রেললাইনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভৃগু ও অনুসূয়া। সামনে ব্যারিকেড তাদের সামনে পদ্মা... নদী দিয়ে নৌকা চলে যাচ্ছে। ওরা দু’জনে ওদের দেশের কথা ভাবছে, ভাবছে ফেলে আসা স্মৃতির কথা। “যখন তুমি বললে ওপারেই তোমার দেশের বাড়ি তখন আমি কি করছিলাম জানো? আমার বাড়িটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম!...যে রেললাইনটার উপর আমরা দাঁড়িয়েছিলাম কলকাতা থেকে ফেরার সময় ঠিক ওখানেই আমরা ট্রেন থেকে নামতাম।...ওখানে দাঁড়িয়ে একটা মজার কথা মনে এল, মনে হল ওই রেল লাইনটা তখন ছিল একটা যোগ চিহ্ন ,আর এখন কেমন যেন বিয়োগ চিহ্ন হয়ে যায় ওখানে যেন দেশটা কেটে দুটুকরো হয়ে গেছে”, ভৃগু বলল।


 দুজনের স্মৃতি যেন কেমন হাত ধরে হেঁটে যায়...আস্তে আস্তে হেঁটে ফিরে যায় ফেলে আসা সময়টায় যখন রেললাইনটা একটা যোগ চিহ্ন ছিল, যখন দেশটা কেটে দুটুকরো হয়ে যায়নি... নদীর ধারের গাছগুলো হঠাতই তীব্র ভাবে দুলতে শুরু করে। বাতাসের আওয়াজ, তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। ক্যামেরা ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে এগিয়ে চলে রেললাইন ধরে (ট্র্যাক ইন করে)...এগিয়ে যায় ব্যারিকেডটার দিকে যার ওপারেই পদ্মা যে লাইনটা একটি ভূখন্ডের বিয়োগ চিহ্ন হয়ে গেছে। আবহে বহু কন্ঠে শোনা যায়, ‘দোহাই আলি!’ ক্যামেরা এগিয়ে চলে ব্যারিকেডের দিকে একসময় স্পেস ফুরিয়ে যায়...ব্যারিকেড দেশভাগ আর অন্ধকার মিলেমিশে এক হয়ে যায়, পর্দার রঙ কালো হয়ে যায়। 

কারণ ব্যারিকেডের ওপাশে যে পদ্মা, রেললাইনটি শেষ হয়ে গেলে একটা দেশ কিভাবে যেন দুটো দেশ হয়ে যায়। আর যারা চেয়েছিল এই বিচ্ছেদ যেন না ঘটে, যাদের পিঠ থেকে কাঁটাতারের দাগ ওঠেনি এখনো...তারা ভগবানকে প্রার্থনা করে, জানায় দোহাই ভগবান এই বিচ্ছেদ ঘটতে দিওনা। কারণ বিচ্ছেদের ওপাশ যে গাঢ় অন্ধকার যেখানে আর নিজেদের পরিচয়  খুঁজে পাওয়া যায়না। যেখানে দাঁড়িয়ে অনুসূয়া ভৃগুর দিকে তাকিয়ে বলে, “জানেন ওপারেই কোথাও আমার দেশের বাড়ি! এখানের আকাশটা ধোঁয়া নয়!”
অনুসূয়া ফার্দিনান্দের জন্য অপেক্ষা করে থাকে বহু বছর, যে ফার্দিনান্দ তাকে মিরান্ডা বলে ডাকত। ভৃগুকে জানায় সমরের কথা যে প্যারিসে থাকে, যার জন্য তার মিরাণ্ডা অপেক্ষা করে থাকে বছরের পর বছর। আর এদিকে তাকে ‘শকুন্তলা’ নাটকে অভিনয় করায় ভৃগু...শকুন্তলার চরিত্রে। এক রাত্রে ভৃগুর সাথে কথা কাটাকাটির পর অনুসূয়া বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোয়, সে জানে এসব ছেড়ে তাকে সমরের কাছে চলে যেতে হতে পারে, সে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটি ছোট মেয়ে তার আঁচল টেনে ধরে , বলে ‘দিদি পয়সা দেনা!’ একজন লোক হঠাতই তার কাছে এসে টাকা চায়...দূরে গিয়ে বলে ‘ভৃগু আপনাকে ঠিকই চিনেছে, আপনাদের মত বাংলাদেশে আছে তাই আমরা আছি আপনারা থাকুন!” বাচ্ছা মেয়েটি ছুটতে থাকে অনুসূয়ার পিছু, নানা রকম শব্দ কানে আসে। মনে পরে বেশ কিছু সময় আগের একটি দৃশ্য যেখানে একটি ছোট্ট কেবিনে ভৃগু অনুসূয়াকে শকুন্তলার চরিত্রটি অনুভব করতে শেখাচ্ছিল...বলছিল মনে করোনা একটি বাচ্ছা মেয়ে যদি তোমার আঁচলটা টেনে ধরে, ধরে নাওনা সেই হরিণ শাবক। যদি এসব ছেড়ে তোমায় চলে যেতে হয় তোমার কিরম কষ্ট হবে! ভৃগুর বর্ণনা করা শকুন্তলার অনুভূতিরাই কেমন সত্য হয়ে ওঠে, অনুসূয়ার সাথে ঘটতে থাকে সেসব কিছু...যাবতীয় পিছুটান তাকে বেঁধে ফেলতে থাকে মনে করিয়ে দেয় সে যে তার অজান্তেই ভৃগুর শকুন্তলা হয়ে উঠেছে তার আর বিদেশ যাওয়া হবেনা। অনুসূয়া বাড়ি আসে, আবহে শোনা যায় বন্দুকের আওয়াজ যেন কাছেই কোথাও যুদ্ধ লেগেছে এক ভয়ানক যুদ্ধ। অনুসূয়া তার দাদাকে জানায় সে খুব বুঝতে পেরেছে সে ভৃগুকে ছাড়া বাঁচবেনা কিন্তু দৃশ্য অনুযায়ী কথাটি শোনা যায় সিঁড়ির উপর থেকে যেখানে অনুসূয়া সিঁড়ির নিচে বসে আছে। তার দাদা জানায়, “প্যারিস থেকে ফার্দিনান্দ নামে একটি ছেলে এসেছেন নাম বললেন সমর, উপরের ঘরে অপেক্ষা করছেন!” আবহে শোনা যায় কারা যেন আবার ‘দোহাই আলি’ বলছে। এরকম কখনো ঘটেনা, এক ব্যক্তির দুই নাম হয়না! তবু এই দৃশ্যে হয়। কারণ এই দৃশ্যে শকুন্তলাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় তার শকুন্তলা হওয়া হবেনা...তার ফার্দিনান্দ তার জন্য অপেক্ষা করছে তাকে সব ফেলে শকুন্তলার সাজ ফেলে মিরাণ্ডার পোশাকে ফার্দিনান্দের সাথে বিদেশ চলে যেতে হবে! সিঁড়ির উপর থেকে ক্যামেরা আবার ট্র্যাক ইন করে সিঁড়ির নিচে বসে থাকা অনুসূয়ার দিকে নামতে থাকে, আবহে বাজতে থাকে দোহাই আলি! সিঁড়িগুলো কেমন যেন রেললাইনের মত মনে হয়...শব্দটা মাথার ভেতর আঘাত করে মনে করিয়ে দেয় রেললাইনের দৃশ্যটি। শুনতে পাই, “দোহাই আলি”...ক্যামেরা অনুসূয়ার কাছে পৌছায় তারপর আমরা অন্ধকারে হাতড়াতে থাকি একটা সম্পর্ককে, যার বিচ্ছেদ আমরা চাইনি! কিছুক্ষণ আগে শুনতে পাওয়া বন্দুকের শব্দ দেশভাগের সময়কার সেই যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয় , যে যুদ্ধের পরের পৃষ্ঠাতে বড় করে বিচ্ছেদ লেখা আছে। সিঁড়ি বেয়ে ক্যামেরা যখন নেমে আসে ভগবানকে প্রার্থণা করি আমরা যে এই বিচ্ছেদ ঘটতে দিওনা, এই বিচ্ছেদ মেনে নেওয়া যায়না। সিঁড়ির ওপরেই যে ফার্দিনান্দ অপেক্ষা করছে সিঁড়িটাও যে তাই কেমন বিয়োগ চিহ্ন হয়ে যায়। শকুন্তলা উপরে গেলেই যে তাকে মিরান্ডা হয়ে যেতে হবে। সিঁড়িতে তাদের বিচ্ছেদের কথা লেখা আছে।



 শুধুমাত্র শব্দের ব্যবহার করে, পরিচালক দুই বিচ্ছেদকে এক করে দেন। একটি দেশ একটি শরীরের মত যার মাঝখান দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে আর গেছে সারিসারি কাঁটাতার, আঘাত থেকে এখনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। স্মৃতিকে তো ছুঁইয়ে দেখা যায়না তাই ভৃগু অনুসূয়ার স্মৃতিতে আমরা হাত বুলাতে পারিনা নয়তো স্মৃতির রক্ত আমার হাতেও লাগত।  একইভাবে ভৃগু অনুসূয়া কখন যেন এক ও অভিন্ন মানুষ হয়ে গেছে, ওদের বিচ্ছেদও মেনে নেওয়া যায়না। শব্দের সেতু গড়ে পরিচালক বিচ্ছেদকে পাশাপাশি এনে রাখেন তারপর মিলিয়ে দেন, সেতুর ওপারে দুইটি দেশ দাঁড়িয়ে আছে আর এপারে দাঁড়িয়ে আছে দুটো মানুষ। ওদের মধ্যে অবাধ ভালোবাসা, টান! দুটো দেশ, একটা শরীর আর দুটো মানুষ...বিচ্ছেদ যে বিচ্ছেদই, তার নাম গোত্র পালটায় না।


আমাদের ক্লাসরুমের বাইরে একটা জানলা আছে, ভেতরে নেই...ভেতরে আছে শুধু শীতলতা। আমাদের সেই জানলার সামনে একটা বেঞ্চ রাখা আছে। যখন প্রথম প্রথম ইয়ুনিভার্সিটি যাওয়া শুরু করি ওই বেঞ্চ, ওই জানলা...জানলার ওপাশে বিকেলবেলা এসবই আমাদের কাছে যোগচিহ্ন ছিল। ক্লাস শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে যেত, আজও বিকেল হয়ে যায়। জানলার সামনে এসে দাঁড়াই বা বেঞ্চে বসি... এগুলোই একদিন বিয়োগ চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। সামনে সিঁড়িটা নেমে গিয়েছিল অজানার দিকে, জানিনা সিঁড়ির নিচে কোনো শকুন্তলা অপেক্ষা করে ছিল কিনা। লেখাটার নাম “আমরা, বিচ্ছেদ ও কোমল গান্ধার” হতে পারত যদি সিঁড়ির নিচে অজানাটি জানা থাকত।



ছবি সৌজন্যে ঃ 'কোমল গান্ধার'