আমাদের এক জানা গল্প আছে। এক নাম না জানা লেখকের গল্প…যিনি তার প্রিয় পরিবার ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছিলেন, পাল্টে যাচ্ছিল তাঁর বাঁচার কারণট্টা…কিংবা বাঁচার কারণ ছিলনা আর কোনো। তাই অজান্তেই একটা সেলের মধ্যে প্রবেশ করে আর বেরিয়ে আসতে পারেননি এবং তার সাথে অসময়েই দেখা হয়েছে মৃত্যুর! ‘ডুব’ ছবিটিও সেই জানা গল্পটিই বলে। পরিচালক আশা করেন কিংবা ধরেই নেন দর্শকের ছবির ন্যারেটিভটি জানা। একই ঘটনা যখন আমরা প্রত্যেকে দেখি বা প্রত্যেকে শুনি তার সাথে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিটুকু জুড়ে নিই। ‘ডুব’ ছবিটিতে পরিচালক শুধু চেনা ন্যারেটিভটি দেখার একটা প্রাসপেক্টিভ তৈরি করে। হুম, যে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার কথা কেউ ভাবেনি। সামাজিক বাঁধাধরা নিয়মে যা খারাপ যা দৃষ্টিকটু তাকেই স্ক্রিনে ‘ডুব’ এমনভাবে প্রতিস্থাপন করে যা চোখকে শান্তি দেয়, এক ঘনিষ্টতার অভিজ্ঞতা তৈরি হয় আমাদের…
‘ডুব’ সিনেমার মূল চরিত্র একজন ছবি পরিচালক জাভেদ হাসান(অভিনয়ে ইরফান খান)। সারা ছবি জুড়ে তাঁর খ্যাতি নিয়ে আমাদের
আলাপ হয়না আমরা ওঠাবসা করি শুধু মানুষটির সাথে। ঢাকা শহরের মতো একটি ব্যস্ত শহরেও ছবির কোনো ফ্রেমে সেই ব্যস্ততাকে দেখতে পাইনা। যা পাই তা হলো কতগুলো মানুষ বা চরিত্র যারা একগাদা অনুভূতিদের বয়ে বেড়াচ্ছে…একটি ফ্রেম থেকে আরো একটি ফ্রেমে নিজের উপস্থিতিতে পৌঁছে দিচ্ছে অনুভূতি। ছবির শুরুতেই দেখা যায় একটি সমুদ্রতট, যেখানে একের পর এক ঢেউ আসছে আর সমুদ্রতটে এক নৌকা বাঁধা। হয়তো এই দৃশ্যটিতেই সমস্ত ছবির কথা বলা আছে…এরপর থেকেই ছবিটি নিজের এক একটি ভাঁজ উন্মুক্ত করে…একটু একটু করে বিস্তার করে দেয় শাখা প্রশাখা যা শহরের ভিড় পেরিয়ে একদম আমাদের মনে এসে পৌঁছায়। কলেজের রিইউনিনে দেখা হয় নিতু( অভিনয়ে – পার্ণ মিত্র) এবং সাবেরীর…তবু দুজনের মধ্যে একটা দেওয়াল একটা দূরত্ব যা পেরিয়ে একে অপরের কাছে আসা যায়না, ফিরে যাওয়া যায়না ছোটবেলায় যেখানে ওরা নিজেদের মনের কথাগুলো অকপটেই বলে ফেলতে পারত।
জাভেদ হাসান
তাঁর স্ত্রী-এর সাথে কাটানো পুরোনো মূহুর্তগুলোকে মিস করেন। পাহাড়ে
ঘুরতে এসে স্ত্রীর সাথে স্মৃতিচারণ করেন যে সময়ে তারা ভালোবাসার জার্নিটা শুরু করেছিলেন
সবে। তিনি তার হাতের ঘড়িটি খুলে চুপচাপ নদীর জলে ফেলে দেন যাতে স্ত্রী-এর সাথে কাটানো
মুহূর্তকে মিনিটে বা ঘণ্টায় হিসেব না করা যায়, যাতে সেই সময়টাই শেষ না হয় কখনো।
‘ডুব’- এ সম্পর্করা আছে, আছে ভালোবাসা আর পিছুটান, তাই
পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিতুর সাথে বিবাহিত জীবন শুরু করার পর ও জাভেদ হাসান হঠাত
একদিন রাত্রিরে তার একমাত্র মেয়েকে ফোন করে তাঁর মুখ থেকে বাবা ডাকটা একবারের জন্য
শুনতে চান। সম্পর্ক কখনো শেষ হয়ে যায়না বলেই হাজারো অভিমানের টানাপোড়েনের ওপাশে
মেয়ে তার বাবার কফিন জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার বাবাকে জানায় সে তার বাবাকে
ভালোবাসে।
বাস্তবে জীবন কতটা কাব্যিক হয় জানিনা, কিন্তু ‘ডুব’-এর
প্রত্যেক চরিত্রের চলন বলন ভীষণ কাব্যিক। বাবার মৃত্যু খবর পেয়ে সাবেরী বাথটাবে
শুয়ে থাকে , খোলা থাকে জলের কল...সেই জল উপছে সিঁড়ি বেয়ে নিচে গড়িয়ে আসে। একটি
ফ্রেমকে যদি বর্ণনা করা হয় মনে হবে কবিতার একটি লাইন পেয়েছি। যেমন--- মাঝে দূরে এক
কংক্রিটের বাড়ি আর ফোর গ্রাউন্ডে দুধারে গাছ। সময়ের গতিকে বারবার ভেঙে দিয়ে একটি
সাধারণ ন্যারেটিভকে অন্যমাত্রা দেওয়া হয়। শুধুমাত্র সময় এবং পরিসরের ব্যবহার করে
ক্যামেরার ধীর মুভমেন্ট দ্বারা যে কবিতা লেখা যায়, তাই প্রমাণ করে ‘ডুব’। বিশ্বাস
করা হয় মৃত্যুর পর মানুষ সব নিয়মের উর্দ্ধে চলে যায়। যখন সবাই তাঁর মৃতদেহ আঁকড়ে
পরে আছে তখন তিনি সব ভিড় কাটিয়ে তার স্ত্রী-এর সাথে সময় কাটাচ্ছেন নিভৃতে আর সময়ের
এখন সত্যিই শেষ নেই। অন্যান্যরা যখন জাঁকজমকে গা ভাসিয়েছে, সেই সময় ডুব সমুদ্রের
ধারে বসে একটার পর একটা ঢেউ গোনে। ঝিমধরা আলো, ধীর ক্যামেরামুভমেন্ট অনুভূতিদের
গল্প লেখে...
এক একটি ঢেউ কাছে আসে আর জানিয়ে যায় সম্পর্কের কখনো শেষ হইয়না,
ফুরিয়ে যায়না ভালোবাসাও। সিস্টেমের বাঁধা ধরা নিয়মের জালে পরে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে
যায় শুধু, অসময়েই তাদের সাথে মৃত্যুর দেখা হয়। আবার ও ঢেউ দূরে চলে যায়, ছবির শেষে
সমুদ্র তটে তখন ও বাঁধা থাকে সেই নৌকাটি যে সব অনুভূতির সাক্ষী, যে প্রত্যেকটা
ঢেউয়ের সাক্ষী...যে একটি মানুষের হারিয়ে যাওয়ার বা ‘ডুব’-এর সাক্ষী!