এমনিতে কালীপুজোর পরের সন্ধেবেলাটা ফাঁকা থাকিনা, পাড়ার ফাংশানটা
নিয়ে ব্যস্ত থাকি অন্যান্য বছর। ছোটবেলায়
সারারাত হৈ হুল্লোড় করতাম। বড়ো হওয়ার সাথে সাথে যদিও সেই হৈ হুল্লোড়ের ইমেজটা
কিছুটা পালটে গেছে কিন্তু হৈ হুল্লোড় করাটা বন্ধ হয়ে যায়নি মোটেই। এক এক বছর
কালীপুজো আসে, সময়গুলো পাল্টে যায় কেমন...পাল্টে যায় সম্পর্কগুলোও। না! মন খারাপ
করছিনা। সবার যেমন মন খারাপ হয় আমার কথায় কথায় হয় পেট খারাপ। আজ পেটটাও খারাপ না,
তবুও কেমন যেন বিজয়া দশমীর মত ভারী হয়ে আছে মনটা। বৃষ্টি হয়ে সবটা ম্যাচাকার করে
দিয়েছে। আমাদের প্ল্যান, আড্ডা সব! কাল থেকেই প্যান্ডেলের ভেতর জল, ‘আলপনা’ তো
‘জলপনা’ হয়ে গেছে...১০৮টা প্রদীপ দেওয়ার সময়, ‘না-কাদা’ জায়গাটাই আতশ কাচ লাগিয়ে
খুঁজতে বসতে হয়েছে আমাদের।
কালীপুজোকে আমার যতটা কোনো দেবতার পুজো মনে হয়
তার থেকেও মনে হয় আমরা আলোকে সেলিব্রেট করছি। আনন্দ করছি আলোদের নিয়ে, রাস্তার
সামনের বাঁকটা থেকে ঘরের কোণগুলো পর্যন্ত আলোয় মুড়িয়ে রাখি। আলোও কত
রকমের হয় তাইনা? সাদা, নীল, লাল, সবুজ....রঙ বেরঙের আলো! আমাদের কাছে আনন্দ করার, সেলিব্রেট করার বিষয় এত কম...তাই ছোট ছোট এই আনন্দগুলোও বৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়ে যেতে
বসলে খারাপ লাগে। দুর্গাপুজোয়
বছর তিন চার ধরে বৃষ্টি হতে হতে যেমন ওটা অভ্যেস হয়ে গেছে, কালীপুজোর ক্ষেত্রে এই বৃষ্টি
ব্যপারটা যেহেতু নতুন,তাই পুজোর জায়গায় জমা জলটা ঠিক হজম করে উঠতে সময় লেগেছে।
যাই হয়ে যাক, আনন্দ যে কোনো ভাবে হাতছাড়া করা
যাবেনা তা বাজির বহরই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছে। বন্ধ জানলার ভেতর থেকে যেমন বৃষ্টির শব্দ আসছে সেসব
ছাপিয়ে আসছে তীব্র বাজির শব্দ। আমার এই
দুই শব্দই ভালো লাগছে, কিন্তু মন ভালো লাগছেনা।
আমাদের এখানে প্রত্যেকটা বাড়ি
বেশ আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে, আমি আর বাবা কালিপুজোর আগের দিন অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ছাদ থেকে নীল, সাদা আলো ঝুলিয়ে দিয়েছি! ঠাম্মাকে বলছি, দেখেছ ঠাম্মা সব বাড়িতে আলো
লাগিয়েছে কিন্তু ওই যে ওই বাড়িটায় আলো লাগানো না কিন্তু! এটা কি ঠিক? দীপাবলির সকাল চলে এলো, তবুও ওই দোতলা বাড়ির গা বেয়ে
আলো নামলোনা। আমি শুধু
ভাবছি কেন আলো জ্বলবেনা ও বাড়ি, ঠাম্মা বলল দেখ বাড়ির ওপাশে আলো জ্বলবে হয়তো! দীপাবলির সন্ধে পরে, তাও ওদের বাড়ি আলো জ্বলেনা।
আমি তখন হাওয়ার সাথে যুদ্ধ করে মোমবাতি লাগানোর
বৃথা চেষ্টা করছি দেখলাম ওই দোতলা বাড়ির ছাদে রং মশাল জ্বলে উঠল।
হেসে উঠল ও বাড়ির ক্ষুদে সদস্যদুটি।
মা, বাবা, দাদু, ঠাম্মাকে নিয়ে ফুলঝুরি, তুবড়ি, রঙ মশালে মেতে উঠল ওরা। আমি ছাদ
থেকে দাঁড়িয়ে শুধু হাসির শব্দ শুনছি আর আলোর মহরত দেখছি। ওরা এখানকার তথাকথিত বাকি পরিবারগুলোর মত না, 'না হিন্দু' পরিবার একটি।
আলোর ওই সন্ধেয় আমাদের এক তলার ছাদ আর ওদের দোতলার
ছাদে কোনো পার্থক্য ছিলনা। কোনো
ভেদাভেদ ও না...কারণ সত্যিই আলো সবার, উতসব আনন্দ ও সবার...সেখানে কোনো ভেদ হয়না, সত্যিই না!
আমি বাজি ফাটাইনা, কিন্তু ছাদে দাঁড়িয়ে চুপচাপ
আকাশে ফানুস উড়ে যেতে দেখি। ছোটবেলার
কথা চিন্তা করি। মা, বাবার কাছে গল্প শুনতাম, চামুন্ডা কালির।
দুর্গাপুর ব্রিজের নিচে ঠাকুর ওঠে, সে নাকি ভয়ানক দেখতে...জিভ নড়ে, পেটের ভেতর নাড়িভুড়ি এধার ওধার
করে নাকি, বিশাল চেহারার ওই কালি ঠাকুরকে দেখে বাচ্ছারা ভয় পায় খুব।
আমিও যখন ছোট বেলায় শুনতাম আমার খুব ভয় লাগত, কালীমূর্তিই এমন... তা যতই জাঁকজমকপূর্ণভাবে করা
হোক না কেন, কালীমূর্তির ওই লাল লাল চোখ আর গলায় মুন্ডমালা দেখে পেটের ভেতর গুলুগুলু
করে ওঠে ছোটদের। বড়ো
হওয়ার সাথে সাথে নিজের ভাবনার পরিবর্তন হয়, দৃষ্টিভঙ্গি পালটায়।
মতামত তৈরি হয় নিজের। আমার এই লেখার পরবর্তী ক'টা লাইন সম্পূর্ণ আমার নিছক
কল্পনা, নিজের চিন্তা... কোনো ধর্মীয় গল্পকথা এর সাথে জড়িত নয়। যত বড় হয়েছি দেখেছি, আমাদের সিস্টেমে মেয়েদের নিয়ে
কিছু ধারণা তৈরি করা আছে। ছেলেদের
নিয়েও আছে বৈকি। কিছু কাজ
দুর্বল ও কিছু কাজ সবল এই দুটো ভাগে ভাগ করা আছে। যে কাজ গুলো করলে দুর্বল প্রমাণ হয়, সে কাজগুলো কখনো কোনো ছেলে করতে
পারেনা আবার যে কাজ গুলি করলে সবল প্রমাণ হয়...সে কাজ গুলো একটি মেয়েরে পক্ষে
করা বড়োই দৃষ্টিকটু। "ছেলে হয়ে চোখের জল ফেলে, সে ছেলে মাগীর অধম", এমন মন্তব্য করতে শুনেছিলাম কাকে বেশ।
আসলে মনে আছে কার থেকে শুনেছিলাম, কিন্তু এরম অপ্রিয় নাম মনে পরলে
গায়ের ভেতর কেমন গুলিয়ে ওঠে বমি পায়। আসলে মাগী কথাটা কোনো খারাপ শব্দ নয়, প্রত্যন্ত গ্রাম-এ মাগী অর্থাৎ মেয়েমানুষ কথার
প্রচলন আছে, একই সাতে প্রচলন আছে 'মদ্দা' কথাটির ও। মদ্দা বা
মরদ। কিন্তু মাগী কথাটা প্রত্যন্ত
গ্রাম ছেড়ে ট্রেনে বাসে যখন শহর বা শহরতলির আনাচে কানাচে এসে পোউছায় তখন সে কথাটির
অর্থ হয়ে যায় অন্য। একটু মজা
করলাম! আমাদের আশেপাশে 'হাতে চুড়ি পরে থাক!' 'ঘোমটা দিয়ে থাক' এই ধরণের কথার বেশ আদান প্রদান আছে, এমন কি এখনো! এই ধরণের কথাগুলি দুর্বল বোঝাতে
ব্যবহার করা হয়। সাধারণত
যেসব কাজগুলি বা যা একটি মেয়েকেন্দ্রিক সবই দুর্বল। চুড়ি পরা, পিরিয়ড চলা, ব্রা পরা...এসব ই। আমাদের
পিতৃতান্ত্রিকতায় এসব বিষয়গুলোই বড়ো নিচু করে দেখানো হয়। মেয়েরা কাঁদে খুব স্বাভাবিক...কিন্তু ছেলেরা যেহেতু মানুষ নয়
তাই তাদের কোনো ভাবেই ব্যথা যন্ত্রণা হতে পারেনা। 'মর্দ কো দর্দ নেই হোতা!' বাহ! বাহ! টাকা উসুল, হাউসফুল। পিতৃতান্ত্রিক-এ পুরুষ আর দেবতার মধ্যে
পার্থক্য করতে না পারা গেলেও আমাদের কিছু মহিলা দেবীও আছেন।
যার মধ্যে ভীষণ বিখ্যাত হলেন, লক্ষী দেবী।
'শুনলাম তোমার ছেলের জন্যে মেয়ে খুঁজছো? এক লক্ষীমন্ত মেয়ে আছে, দেখবে নাকি?' হাহা! সবাই লক্ষীমন্ত মেয়ে চায়, কিন্তু কেউ কালীমন্ত মেয়ে চায়
কি? বোধ হয়
না, অন্তত
আমার চোখে পড়েনি।
মেয়েরা
দুর্গার ভাগ, লক্ষীর ভাগ এসব বড় বড় কথা অনেক শুনি...কিন্তু সত্যিই যিনি নিয়ম ভেঙে
বেরিয়ে আসেন তিনি কালীই। মোটামুটি
যা যা একটি মেয়ের আমাদের সিস্টেমে করা নিষেধ তিনি সেসব করেন।
তিনি নিজের শরীরের 'লজ্জার অঙ্গ' গুলো ঢেকে রাখেন না।
সম্পূর্ণ অনাবৃত শরীরই কালীর ইচ্ছে বা পছন্দ।
ক্লিভেজ দেখানো পোশাক, বেশি গা দেখানো পোশাক এসবের
চিন্তাভাবনা গুলোকে অনেক পিছনে ফেলে, সমস্ত
নিয়মকানুনে ইয়ে করে দিয়ে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে তিনি একদমই কুন্ঠা
বোধ করেন না। কালীপুজোয়
শুনেছি গাঁজা, মদ এসমস্ত অর্পণ করতে হয়। কারা বেশ
বলেনা, মেয়ে হয়ে নেশা করে? তাদের ওই চিন্তাভাবনাগুলোকেও গাধার ইয়েতে দিয়ে দিব্ব মদের নেশায় মেতে থাকতে
পারেন তিনি। জোরে
হাসেন, জোরে চিৎকার করেন। নিজের
চুলকে ইচ্ছে মত উড়তে দেন। খাঁড়া
টাড়া হাতে নিয়ে শয়তানদের কাটতে কাটতে দিব্ব এগিয়ে আসেন তিনি।
না তিনি তার গায়ের রঙের পরোয়া করেন না পরোয়া করেন
মানুষের ভাবনার। চুড়ি, শাড়ি, ব্রা...এসবের আশপাশ দিয়ে যান না।
সম্পুর্ণ নিজের মত, নিজের ছন্দে চলেন।
অর্থাৎ যেসব কাজগুলো একটি পিতৃতন্ত্র এক মেয়ের করা
উচিত বলে ঠিক করে দিয়েছিল সেসবের পরোয়া না করেই তার উল্টো রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু
করেন কালী। বলেন, তিনিই সৃষ্টি...তিনিই ধ্বংস।
আমদের হিন্দুবিশ্বাসে, ভগবান শিব হলেন জগতের পিতা, তিনি সর্ব শক্তিমান।
এতটাই শক্তিমান, এতটাই ক্ষমতা রাখেন যে শুধু
তাকেই নয়...'শিব লিঙ্গ' কেও দুধ গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করানোর নিয়ম প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে।
এসব কিছুই না, পুরুষত্বের আরাধনা।
পিতৃতান্ত্রিকের শক্তি বুঝিয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা
মাত্র। আর এদিকে যখন আমরা কালীমূর্তির
কথা চিন্তা করি, দেখি পৃথিবীর সর্ব শক্তিমান পুরুষের বুকের উপর পা দিয়ে লকলকে জিভ বের করে
তিনি সশরীরে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যপারটা
সহজ ভাবে দেখতে গেলে, সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষের বুকের উপর পা তুলে যে দাঁড়িয়ে থাকে সেই সবথেকে
শক্তিশালী হয়ে ওঠে, কিন্তু আমাদের সমাজে সবাই তা মেনে নেবে কেন? কালী যতই হোক একজন মেয়ে।
তাই এরপেছেনেও এক গল্প কথা চালিয়ে দেওয়া হয়, কালীকে শান্ত করার জন্য এই গোটা
বিশ্ব সংসারকে বাঁচানোর জন্য কিভাবে ভগবান শিব কালীর পায়ের নিচে শুয়ে পরলেন আর
কালীও সেই লজ্জায় জিভ বার করে ফেললেন! এসব গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, চুইনগাম চিবোতে চিবোতে যেমন
তেতো হয়ে যায় এসব গল্প কথাও তেমন। আমার মনে
হয়, কালীমন্ত
মেয়ের বড়ো প্রয়োজন। লক্ষীদেবী
বড় শান্ত, নারায়ণের সেবা করে তার দিন পার হয়ে যায়। এসব কন্সেপ্ট আর চলবেনা! এখন ঘরে ঘরে কালীমন্ত মেয়েরা
বড়ো হয়ে উঠুক। যারা
নিজেদের শরীরের অংশগুলো ঢাকার কথা ভাবেনা। কোনো খারাপ নজর বা কটুক্তির জবাবে এলোচুলে খাঁড়া হাতে
দৌড়ে যায়। রাগে অস্থির হয়ে কেটে ফেলে এক
একটা শয়তানের মাথা। ইচ্ছেমত
নেশা করে, না কাউকে পাল্লা দিয়ে নয়( এরম এক ভুল ধারণাও প্রচলিত আছে, যে মেয়েরা নাকি ছেলেদের পাল্লা দেওয়ার জন্য নেশা ভাং
করছে) নিজের মন মত নেশা করে। আর
লিঙ্গভেদ ছাপিয়ে লিঙ্গপুজোকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে... পিতৃতান্ত্রিকের বুকে পা দিয়ে
দাঁড়িয়ে থাকে।
কোনো কাজ না থাকলে অনেক চিন্তা
মাথায় আসে, বেকার বা 'না বেকার'...সেসব চিন্তাদের লিখে ফেলি। কালীপুজোয়
কালীদেবীর কথা চিন্তা করি, ওনার ক্ষমতা ওনার শক্তির কথা চিন্তা করি। ডেস্কটপে ওয়ালপেপার পালটিয়ে এক রুদ্র উগ্র কালীর ছবি
রাখলাম। সম্পূর্ণ ঘর অন্ধকার।
শুধু জানলা দিয়ে বিদ্যুতের আলো মাঝে মাঝে ঘরে এসে
পড়ছে, আমার ভয় লাগছে বেশ ছোটবেলার মতই। মনে হচ্ছে, হঠাতই একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনব কার কাটা মুন্ডু রাস্তার ধারে পাওয়া গেছে।
ভিড় জমে আছে ওখানে, একটি মেয়ে এগিয়ে আসছে ভিড়ের
ভেতর থেকে...মুন্ডুটা শনাক্ত করে বলছে এই তো সেই ছেলেটাই যে ওকে...বলে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠছে।
এক এক মুন্ডু কাটার খবর পেয়ে ভয় পাচ্ছে তারাও যারা
স্লোগান দিয়েছিল, 'না দুর্গা না কালী...আব রহেঙ্গে বজরংবলী'। ভাবতে ভয়
লাগছে আমার, আমি ডেস্কটপের ওয়ালপেপারের দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে এখনই ছবিটা সত্যি হয়ে উঠবে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরবে কালীমন্তরা, হয়তো আমিও।
মনে পড়ছে, পুজোর সময় একটি অটোর পেছনে লেখা
দেখেছিলাম, ' বন্দে পুরুষোত্তম'। বৃষ্টি পরছিল ভীষণ, আমার ও নেশা চোখে অটোর কাঁচ
টাকে পাব্লিক টয়লেটের দেওয়াল মনে হচ্ছিল...যার গায়ে ওই লেখাটার উপর প্রস্রাবের ফোঁটা আর নোংরা লেগে
আছে।