‘সহজ পাঠের গপ্পো’ নিয়ে আলাদা ভাবে কিছু প্রকাশ করার নেই,
ছবি সংক্রান্তও কিছু লেখার নেই তেমন। আমার এরম কেন হয় জানিনা যে ছবি নিয়ে মুগ্ধ
হয়ে যাই সেই ছবির ভালো মন্দ সুর বেসুর কিচ্ছু বোধ করার ক্ষমতায় থাকিনা। ছবি দেখার
পর থেকে অনেকক্ষণ পর পর্যন্ত ছবিটার প্রত্যেকটা দৃশ্য নিয়ে ভেবে যাই শুধু আর
মনেমনে মুগ্ধ হই। ‘সহজ পাঠের গপ্পো’ ছবিটি নিয়ে কোনো আলোচনা করবনা শুধুমাত্র নিজের
এক্সপেরিয়ন্সটুকু শেয়ার করব।

সেদিন বিকেলে এমনিই ভীষন মন খারাপ লাগছিল, যে কোনো
আগ্রহের ছবি আদিকে ছাড়া দেখে নিতে হবে ভাবলেই খারাপ লাগে, ও বিকেলবেলা কলকাতা
পৌঁছতে পারবেনা জেনে খুব মনখারাপ ছিল। একটা টিকিট হাতে নিয়ে সিনেমা হলের বাইরে
দাঁড়িয়ে আছি, মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ শহরটা জুড়েই যেন মন খারাপ। হঠাত প্রচুর ক্ষুদে
মানুষ তাদের মা-এর হাত ধরে দেখি ভিড় জমাচ্ছে, তাদের মা-এরা বলছেন, ‘সহজ পাঠের
গপ্পো’ তো ছোটদের সিনেমা, তাদের আলোচনা থেকে বুঝতে পারি স্কুল থেকে দায়িত্ব নি্যে
তাদের ছবিটা দেখতে পাঠিয়েছে। এরপর ছবিটা শুরু হয়, স্ক্রিনে দেখতে পাই দুজন বাচ্ছা
ছেলে এক পুকুরে ছিপ ফেলে বসে আছে। তাদের মধ্যে ছোট ছেলেটি অন্যজনকে জিজ্ঞেস করে,
‘দাদা, বাবা আর বাঁচবেনা?’ এইরম একটা অনিশ্চয়তা থেকে ছবির শুরু, তাদের কথোপকথনে
প্রকাশ পায় তাদের না খেয়ে থাকা মুহূর্তগুলো...দু’তিন দিন তারা ঠিক করে খেতে পায়না।
ছোট ভাইটি শুধু স্বপ্ন দেখে কবে একটু ভালো করে খেতে পাবে, যে কোনো কাজের শেষে
একগাল হাসি মুখ নিয়ে দাদাকে জিজ্ঞেস করে, দাদা এরপর আমরা ভাত খেতে পাব তো?
গ্রামের এক অবস্থাপন্ন পরিবারে ঘটা করে জন্মাষ্টমী অনুষ্ঠিত হয়, গ্রামের অনেক
মানুষকে সেখানে নিমন্ত্রন করা হয়। ছোটভাইটি বন্ধ চোখে এবং খোলা চোখে স্বপ্ন দেখে
তারা সে বাড়িতে খেতে গেছে। মা’কে আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করে, ‘মা পোলাও কেমন খেতে
হয়?’ জানলায় বসে ঠাকুরের সাথে একমনে কথা বলে, অজানার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে জানতে চায়...ঠাকুর তুমিই বলোনা ওরা আমাদের নেমতন্ন করবে তো?

ছোট ভাইটির আর কোনো ইচ্ছে
নেই আশা নেই, সে শুধু একটাই কথা ভাবে কবে একটু ভাত খেতে পাবে! অভাবের সংসার টানতে
পারেনা তাদের মা, বারবার রেগে যায়...ছেলেদের দুবেলা খাবার না দিতে পেরে বলে
ছেলেদুটো মরে কেন যায়না! এত অবধি পড়ার পর মনে হয় সারা ছবি জুড়ে শুধু মন খারাপ,
এমনিই বিকেল থেকে মেঘ জমা আকাশ, তারপর এখন বৃষ্টি নামার কথা! কিন্তু বৃষ্টি
নামেনা, একটা ছোট জলের ধারে বসে দাদাকে তার ছোট্ট ভাইটি পেয়ারা এনে বলে দাদা এটা
তোর খেয়ে নে! দাদাকে সে ‘মিঠুন’-এর নাচ করে দেখায়, ঝলমলে রোদে আর সবুজে সম্পূর্ণ
সিকোয়েন্সটিকে ম্যাজিকাল মনে হতে থাকে! মনে হয়, ‘সহজ পাঠ’টি খুলে আমরা এক
ভালোবাসার রাজ্যে প্রবেশ করেছি যেখানে সবকিছুই ম্যাজিকাল, যেখানে কোনো মনখারাপ
থাকতে পারেনা। সম্পূর্ণ ছবিটিতে এটিই ভাবার, গাদাখানেক বিষাদের এলিমেন্টস ছবিটি
ভরে থাকলেও ছবিটিতে কোথাও মনকেমন করা নেই, দুঃখ অনেকদূর দিয়ে হেঁটে চলে যায়...ওদের
জীবনের কাছে ঘেঁষতে পারেনা। যেমনভাবে অপু, দুর্গার জীবনে দারিদ্র ছিল, দুবেলা
পরিমাণ মত ভাত ছিলনা...কিন্তু ‘পথের পাঁচালি’-এর কোনো পাতাতেই তাদের জীবনশৈলীতে ‘মন
খারাপ’ নেই। বৃষ্টি ভেজা আছে মনের আনন্দে, ‘সহজ পাঠের গপ্পো’-তেও সেই একইরকম...দুইভাই
বৃষ্টিতে ভেজে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। কাশফুলের বন দিয়ে হেঁটে চলতে থাকে...বারবার মনে
হয় ‘পথের পাঁচালি’-এর কোনো দৃশ্যে আছি...পরিসর(স্পেস)টা একই আছে, সময়টা এগিয়েছে...চরিত্রগুলো
পাল্টে গেছে কেবল।

২০১৭-এর এক স্বপ্নের দৃশ্যে সবুজ মাঠের পাশ দিয়ে ছুটে চলে
যাওয়া রেলগাড়িটার আওয়াজ কেমন স্টিম ইঞ্জিনের মত শোনায়, স্ক্রিনে দেখতে পাই
রেলগাড়ির চাকাগুলো প্রচ্চন্ড গতিতে ছুটে চলেছে। গোপাল(অভিনয়ে- সামিউল আলম) মা মা
করে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে...দুঃস্বপ্নে ভয় লাগে আমারও। পিছনের সিটে বসে থাকা
খুদেরা কেঁদে ওঠে...বলে, ‘মা বাড়ি যাব, আর কিছুতেই থাকবনা!’ অনেকক্ষন ধরে কাঁদতে
থাকে, তাদের মা-এরা বোঝাতে থাকেন, তারা একটা সিনেমা দেখছে এসব সত্যি নয়। তারা রেগে
যান, অভি্যোগ করতে থাকেন...ছোটদের ছবিতে কেন এসব দৃশ্য রাখা হয়...যেখানে ছোটরাই ভয়
পাবে! যিনি ছবি শুরু হওয়ার আগে বলেছিলেন, ‘সহজ পাঠের গপ্পো’ তো ছোটদের ছবি, তিনি
তার কথা ফিরিয়ে নেন। নিজের ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে বেরিয়ে যান সিনেমা হলের অন্ধকার
থেকে, ভাবেন একটু আলোয় গেলে একটা চিপ্সের প্যাকেট কিনে দিলে ছেলেটি শান্ত হয়ে
যাবে। স্ক্রিনে দেখানো ছেলেবেলার মত ছেলেবেলা হতেই পারেনা...ওটা শুধুই সিনেমা
যেখানে কোনো সত্যি নেই! বড়োদের চোখ দিয়ে ছোটবেলাকে একরকমভাবে কল্পনা করা হয়...সেখানে
সেরূপ এলিমেন্টস রাখা হয়...সেই এলিমেন্টসগুলো সাজিয়ে সাজিয়ে ইনোসেন্স তৈরি করা হয়।
‘সহজ পাঠের গপ্পো’ সেসব চিন্তাভাবনার ধার ঘেঁষেনা...সহজ পাঠের গপ্পো এক শিশুর চোখ
দিয়ে দেখাই এক শৈশব...যেখানে দুটো ছোট্ট ছেলে কন্ডোমকে জল বেলুন ভেবে ভুল করে...সংসারের
আসল অবস্থা কি সেই নিয়ে যাদের কোনো ধারণা নেই...তারা শুধু দিন শেষে একটু ভাত খেতে
পাওয়ার কথা ভাবে...ছোট্টু গোপালকে হাসিমুখে খালি জিজ্ঞেস করে, “দাদা ওরা আমাদের কি
খেতে দেবে রে?”...দুই ভাইতে বেশ ঝগড়া করে...আবার বোকার মত সরল প্রশ্ন করে তারা
কাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসে? আমাদের চারপাশে এরম কত গোপাল ছোটু-রা আছে যাদের মায়েরা
তাদের মন রাখার জন্য চিপ্স কিনে দিতে পারেনা...উপরন্তু তারা খেতেও পায়না ঠিকঠাক...তারাও
তাদের মাকে হারিয়ে ফেলার ভয় পায়, দুঃস্বপ্নে কেঁদে ওঠে...টাকার অভাবে স্কুল ছেড়ে
দোকানে কাজ করতে হয়...তবুও তাদের জীবনে কোনো দুঃখ নেই। তাদের জীবনে জানলায় বসে
ঠাকুরের সাথে আনমনে কথা বলা আছে, কাশবন আছে, আছে আল ধরে হেঁটে যাওয়া, পুকুরে ছিপ
ফেলে বসে থাকা আছে, আছে নির্ভেজাল ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব। কিন্তু তাদের সেই ভয়
পাওয়াগুলোও সত্যি, যেগুলো থেকে চাইলেই মুখ ফিরিয়ে থাকা যায়না। ‘সহজ পাঠের গপ্পো’-এ
বারবার বৃষ্টি আসে, কিন্তু সেই কোনো বৃষ্টিই মন খারাপ নয়। বৃষ্টি এখানে কখনো
ছেলেবেলা বা কখনো বৃষ্টিকাল। এখানে চোখের জল মানে চোখের জলই, হাসি মানে হাসিই,
শৈশব-এর অর্থ শৈশবই। সেদিন প্রচুর ক্ষুদেরা ছবি দেখতে আসায়, তারা ছবির প্রথম থেকে
শেষ পর্যন্ত কথা বলেই যাচ্ছিল...সম্পূর্ণ সিনেমা হলে শুধু খুদের ফিসফিস করে কথা
বলা। আমি প্রথমে বুঝতে পারছিলামনা শব্দটা ছবির, নাকি আমার পাশ থেকে আসছে? পুকুর
পার ধরে হেঁটে ফেরা থেকে বাড়ির দালানে বসে ভাত খাওয়া...বা বাজারে শাক বিক্রি করা,
অন্যের বাড়ির কুয়োর পার পরিস্কার করা যেখানে যেখানেই গোপাল আর ছোটু যাচ্ছে...শোনা
যাচ্ছিল খুদেদের ধীর গলায় কথা বলা, হঠাত মনে হচ্ছিল আমার শৈশব আমার কানে ফিসফিসিয়ে
কথা বলছে, আমি এক পাঠ মন দিয়ে পড়ছি যে পাঠে কোনো মন খা্রাপ নেই...এখানে সবকিছুই
ম্যাজিকাল ... এ এক ভালোবাসার সহজ পাঠ...
