যখন কোনো মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয় তখন হয়তো আরো একটা মৃত্যুকে আন্দাজ করা যায়। আমার মনে হয় প্রত্যেক মৃত্যুর মধ্যেই একটা রিদম আড়াল করা থাকে, সেই রিদমটুকুই আমাদের ছুঁয়ে যায় আমরা ‘ছেড়ে যাওয়া’-টুকু অনুভব করতে পারি, দুঃখ পাই! অনেক সময় এমন হয় যার জন্ম নিয়ে লিখতে বসা আর্টিকেলটা এখনো শেষ করে হয়ে ওঠা ওঠেনি, তার মৃত্যূ নিয়ে লিখতে বসতে হয়। এটা একটা রূপকের মত, অর্থাৎ যাঁর জীবনটাই সবে শুরু হল তার মৃত্যুট যদি অনেক তাড়াতাড়ি চলে আসে তার রিদম বাকি মৃত্যূদের থেকে আলাদা হয়, সেই অনুভূতির ছুঁয়ে যাওয়াটুকুরই আভাস দেয় ‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’, যেখানে মৃত্যু একটা নিষ্ঠুর কবিতা, যে কবিতা যৌবনের পরোয়া করেনা…যার আছে শুধু মনখারাপ!
সেদিন অনিন্দ্য দা ক্লাসে পড়ানোর সময় একটি ছবির উদাহরণ দিতে গিয়ে একটা কথা বলেছিল, কাল ছবিটির প্রথম দৃশ্যে সেই কথাটিই খুব মনে পড়ছিল।
প্রাণ যখন শরীর থেকে একবার বেরিয়ে যায় তখন তা তার শরীরটিকে দেখতে পায়, পাশে এসে বসতেও
পারে কিন্তু ফিরে আসতে পারেনা। সবই দেখতে পায়, কাছের লোকের গাড়িতে করে ফিরতে পারে কিন্তু
তাদের আর ডাকতে পারে না।
‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’ ছবিটির প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় একটি
গাড়ি ‘কে.সি.এম হাসপতাল ও মর্গ’-এর সামনে থেকে কলকতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। Brian ( অভিনয়ে -Jim Sarbh) নান্দুকে (অভিনয়ে- Gulshan Devaiah) গাড়ির
পেছনের ডিকিতে কিছু একটা রাখার সময় বলে যে এটার হাঁটুর দুটো মুড়ে ফেটাল পসিশনে
রাখি? এবং তাদের কথোপকথন থেকে বোঝা যায় তারা মর্গ থেকে একটি মৃতদেহ নিয়ে কলকাতার
উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছে। গাড়ি চলতে শুরু করে ক্যামেরা প্যানিং করে জুম ইন হয়
‘মর্গ’-এর সাইন বোর্ডে, গাড়িটি অফস্ক্রিন হয়ে যায়।
বিষয়টা কাকতালীয় বা ইচ্ছাকৃত
কিনা জানিনা তবে ভাববার বিষয় এই যে, যখন একজন শিশু মাতৃগর্ভে থাকে তখন তার
শরীরটা সেই একই রকমভাবে থাকে, হাঁটু দুটো সামনে মুড়ে...ফেটাল পসিশনে। মাতৃগর্ভে সে
একটি এরকম বদ্ধ জায়গাতেই থাকে যেখানে চারপাশটা অন্ধকার, গাড়ির ডিকিতেও ব্যপারটা
অনেকটা একইরকম...সেই অন্ধকার, বদ্ধ। পার্থক্য শুধু এটাই মাতৃ গর্ভে সেই শরীরটিতে
প্রাণ থাকে, সে সব অনুভব করতে পারে আর গাড়ির ডিকিতে ফেটাল পসিশনে পড়ে থাকা মর্গ
ফেরত শরীরটিতে পোস্ট মর্টেমের কাঁটা ছেঁড়া আছে কোনো প্রাণ নেই, সে কিছু অনুভব করতে
পারেনা। প্রাণটি শরীর থেকে একবার বেরিয়ে
যাওয়ার পর একই গাড়িতে হয়তো বসে যেতে পারে, কিন্তু ছুঁতে পারেনা! এই কথাটা যতবারই
কাল রাতে খেয়াল হয়েছে ঘুমাতে পারিনি উঠে বসেছি, কঙ্কনা সেন পরিচালিত ‘আ ডেথ ইন দ্য
গঞ্জ’ মৃত্যুকে এরকম ভাবে ভাবতে শেখায়।
এরপর পালাম্যুর জঙ্গলের রাস্তা ধরে
গাড়িটি কলকাতার দিকে ফিরতে শুরু করে, স্ক্রিন ফেড হয়ে যায়...টাইটেল দেখা যায়। এরপর
আবার যখন আমরা ছবিতে ফিরে আসি, ফিরে আসি সেই একই রাস্তায়...তবে ছবির সূত্র ধরে
আমরা এখন সাতদিন আগের সময়ে। ১৯৭৮ সালের শেষ সপ্তাহ, ক্রিসমাস উইক সেলিব্রেট
করতে একটি পরিবার আসে ম্যাক্লাক্সিগঞ্জে। জায়গাটির নামেই
একটি কেমন রূপকথার ধাঁচ আছে, যা এই বাস্তবটা থেকে অনেক
দূরে, এক জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এক অন্যরকম জায়গার উদ্দেশ্যে।
তবে ছবির প্রধান চরিত্র
শুতু (অভিনয়ে - Vikrant Massey) এসবের থেকে বেশ খানিকটা দূরে, তার মধ্যে একটা ছাড়াছাড়া ভাব।
সে বইয়ের ভেতর মথ রাখে, সে বাড়ির সবথেকে ছোট সদস্য-এর সাথে কাটিয়ে দেয় সব থেকে বেশি
সময়।
চিন্তা, পরিশ্রম এই ম্যাক্লাক্সিগঞ্জের এই পরিবার গেট টুগেদারে ঢুকতে না পারলেও
পিছু ছাড়েনা হতাশা। শহর থেকে অনেক দূরে এই মোহময় জঙ্গলের ভেতরেও শুতুকে হতাশা সবসময়
তাড়া করে বেরায়, তাড়া করে বেরায় অপারকতা, ফেলিয়োর। শুতু আঘাত পায় নিজের থেকে, নিজের
ভালোবাসা থেকে…পরিবারের বাকি সদস্যদের থেকে…পারিপার্শ্বিক থেকে…সে বারবার আঘাত পায়!
তার পাশ করতে না পারা এম.এস.সি মার্কশীট সে ডায়েরিতে লুকিয়ে রাখলেও বের করে দেখে, পেন
দিয়ে নকশা করতে থাকে সেই মার্কশিটের উপর। একটা ফেলিয়োর থেকে সে পালিয়ে এইখানে ছুটি কাটাতে আসে, ভাবে হতাশা
ফেলে রেখে ফিরে যাবে। কিন্তু ডিপ্রেশন এমন এক জিনিষ যা প্রত্যেক আঘাতে আঘাতে ফিরে আসে,
তা রূপকথায় হোক কিংবা বাস্তবে। পুরো ছবি জুড়ে রিয়ালিসমের মাপকাঠি ঠিক কতটা বা বাস্তব
কতটা আছে তা ভাবতে বসলে হয়না! পুরো ছবিটিই এক কবিতার মত, যার প্রত্যেক ভাঁজে গোপনীয়তা
লুকিয়ে আছে… মোহময় রূপকথার মোড়কে আছে সাসপেন্স ও থ্রিল। ছবিটির নিজস্ব এক কাব্যিক ছন্দ
আছে যা নিজের মত চলে, নিজের এক অন্য স্টাইল এস্টাব্লিশ করে।
ছবিটির শুরু যেখান থেকে হয়েছিল, ছবিটির সূত্র ধরে আমরা সেই সময়েই
ফিরে যাই আবার। এই দিন সাতেকে বাদবাকি পৃথিবীতে আর কি ঘটে গেছে তার কোনো আভাস ছবিটিতে
না পেলেও এই দিন সাতেক আগে ঘুরতে আসা পরিবারটি থেকে যে একটি প্রাণ কমে গেছে তারই গল্প
বলে ‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’। প্রাণটি গাড়ির ব্যাক সিটে বসে ফেলে আসা রাস্তার দিকে তাকায়,
যেন সে জীবনটা ফেলে চলা শুরু করেছে। ‘আ প্রডেথ ইন দ্য গঞ্জ’ এক নিষ্ঠুর কবিতার মতো
যা একটি মৃত্যু দেখায় তবে বারবার বেশ কিছু মৃত্যুর কথা বলে চলে। সম্পূর্ণ ছবি জুড়েই
মন খারাপ, এক হারিয়ে ফেলা! আসলে পৃথীবিতে প্রতিদিন যে আত্মহত্যারা চুপিসাড়ে সংখ্যায়
বেড়ে চলে, তা আসলে আত্মহত্যা নাকি এক একটা খুন? যারা হেরে গিয়ে পালিয়ে গেল, তারা কি
সত্যিই পালিয়ে গেল নাকি তাদের বের করে দেওয়া হল তাদের চৌহদ্দি থেকে, আঘাতের পর আঘাত
এনে বুঝিয়ে দেওয়া হল এ স্থান তোমার নয়। আসলে যারা নিজেকে মেরে ফেলেছিল তারা কেউই ভীতু
নয়, তারা কেউই পিঠ বাঁচিয়ে পালায়নি…তারা স্লিপিং পিল হাতে…বা সিলিং থেকে ঝুলে পড়ার
আগে কিংবা বন্দুকের নলের সামনে শেষবার এটাই বলেছিল , এই মৃত্যুটাই শেষ আত্মহ্ত্যা…নিষ্ঠুরতার
একটি নিঃশব্দ প্রতিবাদ। ‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’- এও মৃত্যু বন্দুকের নলের সামনে এসে দাঁড়ায়,
রক্তের লাল রঙ গাছের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে, সেই লাল রঙ বরাবর নিচে নামতে নামতে একসময়
মনে হয় এক দুঃখের কবিতা পড়ছি, যা্র শেষে একটি নিষ্ঠুর মৃত্যুর কথা লেখা আছে।